কি হতে যাচ্ছে ভারত সফরে? : ডক্টর তুহিন মালিক

প্রকাশিত: ৮:২৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২, ২০১৯

সব প্রধানমন্ত্রীই বিদেশ সফরে কিছু না কিছু আনতে যায়। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গিয়ে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে যায়! আর তাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গেলেই দেশের মানুষের উৎকন্ঠা বেড়ে যায়। ‘এবারও না জানি কিসব দিয়ে আসে?’

প্রধানমন্ত্রীর বিগত ভারত সফরগুলোতে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য হলেও। বিপরীতে ভারত পেয়েছে তাদের চাহিদামত সবকিছুই। ট্রানজিট, ব্যবসা, বানিজ্য, কানেক্টিভিটি, ৭ রাজ্যের নিরাপত্তা, নদী বন্দর, সমুদ্র বন্দর, প্রতিরক্ষা চুক্তি, সামরিক চুক্তি, পুরোনো বাতিল অস্ত্র বিক্রয় …। বৃহৎ রেমিটেন্স প্রাপ্তির পাশাপাশি বিশ লক্ষাধিক অবৈধ ভারতীয়দের উপার্জন। তাছাড়া একচ্ছত্র রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণতো আছেই।

দেশের মানুষের উৎকন্ঠার একটা যৌক্তিক কারন হচ্ছে, ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত প্রায় সকল চুক্তির বিষয়বস্তুই অপ্রকাশিত রেখেছে এই সরকার। অথচ আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তির আগে জাতীয় সংসদে এসব আলোচনা হওয়ার কথা। জনগণের জানা তো দূরের কথা। সংসদে আলোচনা তো দূরের কথা। সরকারি দলের শীর্ষনেতারাই তো কিছুই জানতে পারে না!

আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী দিল্লি সফরে যাচ্ছেন। এবারও লোকদেখানো ডজন খানিক চুক্তি। আর ডজন খানিক সমঝোতা স্মারকের অন্তরালে। ভারতের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের বিধি-বিধান (স্টান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর-এসওপি) সই করাই হবে এই সফরের প্রধান উদ্দেশ্য।

গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। এবারও তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো চুক্তি হবে না। তবে, সান্তনামূলক লোকদেখানোর জন্য ফেনী, ধরলা, দুধকুমার, মনু, খোয়াই, গোমতী ও মুহুরী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ‘ফলপ্রসূ আলোচনা’ হতে পারে।

এবারও যথারীতি মমতা ব্যানার্জির ঘাড়ে সবদোষ চাপিয়ে দিয়ে মোদি নিজেকে দায়মুক্ত প্রমান করবেন। অথচ ভারতের সংবিধানের ২৫৩ অনুচ্ছেদ মতে, যেকোনো দেশের সঙ্গে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার যেকোনো চুক্তি করতে পারে। একটু লক্ষ্য করে দেখুন। প্লান মতো কিন্তু ঠিক দূর্গাপুজার সময়েই এই সফরটি সেট করা হয়েছে। এবারের শীর্ষ বৈঠকে মমতা থাকছেন না। কারন পূজার কারণে তিনি এ সময়টা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেতে পারবেন না। আসলে, কেন্দ্রীয় সরকার মমতাকে দিয়ে খেলছে। মমতাও মোদি সরকারকে নিয়ে খেলছে। ফলাফলে, সবাই মিলেই কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়েই খেলছে।

এই সফরের সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটা হবে, আগরতলায় মহারাজা বীরবিক্রম বিমানবন্দরের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে যদি বাংলাদেশের ভূমি দিয়ে আসার কোন সিদ্ধান্ত হয়। আর বরাবরের মতো এটাও গোপন থাকবে। কারন মিডিয়াসহ দেশের কারোই এখন কোন প্রশ্ন করার দুঃসাহস যে একেবারেই নেই! তারপরও যদি সিদ্ধান্তটি দৃশ্যমান হয়। তাহলে বলা হবে- ‘বাংলাদেশের ভূমি নয়, বিমানবন্দরের লাইট ব্যবহার করা হবে…’!

সফরে দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোন অগ্রগতির নিশ্চয়তা পাওয়া না গেলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে শোনা যাবে- ‘বিষয়টি ভারত সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে।’

আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) বিষয়ে পরিস্কার বলা হবে, ‘ভারত আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছে – এটি তাদের ইস্যু। তাদেরই হ্যান্ডেল করতে দিন। এনআরসি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই।’ অথচ ইতিমধ্যেই কিন্তু তাদের ১৯ লক্ষ নাগরিককে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবার সব প্রস্তুতি তারা সম্পন্ন করে রেখেছে! তারপরও যেন আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন অধিকার নেই!

এবারও ভারতকে সবকিছু দিয়ে বিনিময়ে শুধুমাত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মভিত্তিক ফিচার ফিল্ম তৈরির প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে ভারত সরকার। বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ‘শান্তি পদক’ দিয়ে সম্মান জানাবে।আর সফর শেষে শূন্য ঝুড়িতে আন্তরিকতা, আতিথিয়তা ও সৌহার্দপূর্ন ‘ফলপ্রসূ সফরের’ বার্তা নিয়ে আসবে বাংলাদেশ সরকার।

অন্যদিকে ‘বিশাল অর্জনের’ এই সফরে সীমান্ত হত্যা বা বানিজ্য ঘাটতির মত ইস্যুগুলো কোন এজেন্ডায় স্থান খুঁজে পাবে না!

জনগণ বেশী কিছু জানতে চাইলেই, ‘ক্যাসিনো সম্রাট গ্রেফতার/ক্রসফায়ার’ ইস্যু ছেড়ে দেয়া হবে। ‘খালেদা জিয়ার জামিন/বিদেশে চিকিৎসা’ ইস্যুও তৈরি রাখা আছে। এতে কাজ না হলে, চিরাচরিত ‘জঙ্গি আস্তানা’ ইস্যু কিংবা ‘পূজা মন্ডপে হামলার’ সাম্প্রদায়িক ইস্যু তো প্রস্তুত রয়েছেই। এর সংগে ‘আইএসের দায় স্বীকারের’ গৎ রেডি থাকেই। তাই, তিস্তার পানি খাওয়ার দরকার নাই, নিত্যনতুন ইস্যু তো খেয়েই চলেছে এ জাতি!

-ডক্টর তুহিন মালিক: আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ