এদেশে সংখ্যাগুরু মুসলিমরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে: পিনাকী ভট্টাচার্য

প্রকাশিত: ৫:১৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৫, ২০১৯

বাংলাদেশের সেক্যুলারেরা ট্রাম্পের কাছে করা প্রিয়া সাহার নালিশ প্রসঙ্গে বলছেন যে, ‘প্রিয়া সাহা দুর্বল ইংরেজীতে তার কথাটা ঠিকমতো বলতে পারেনি। কিন্তু তার অভিযোগ তো ঠিক আছে, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন তো হয়ই। এটা তো আর মিথ্যা নয়’।

এই বক্তব্যের সত্য মিথ্যা নির্ণয়ের আগে আসুন আমরা এই ‘হিন্দু নির্যাতন’ শব্দবন্ধ নিয়ে আলাপ করি। আপনি যখন কোন রাষ্ট্রের নাগরিকদের (এখানে ধরা যাক হিন্দু সম্প্রদায়) একাংশকে আলাদা করে তার উপরে হওয়া নির্যাতন নিয়ে কথা বলেন তখন এটা অনিবার্যভাবে ধরে নিতে হবে এই সম্প্রদায়ের বাইরে আর কেউ নির্যাতিত হয়না বা হলেও সেটা উল্লেখ করার মতো নয়।

‘হিন্দু নির্যাতন’ শব্দগুচ্ছ দিয়ে যা যা বুঝানোর চেস্টা করা হয় সেগুলো আলাদাভাবে একটু আলাপ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে আওয়ামী শাসনে সবচেয়ে বড় হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশনের ঘটনা হচ্ছে ক্রস ফায়ারে বিচার বহির্ভূত মৃত্যু। ২০১০-২০১৮ সালে ক্রসফায়ারে দেশে মোট মৃত ১৭৬৬ জনের মধ্যে মাত্র একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের। অর্থাৎ, ক্রসফায়ারের ভিকটিমদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা ০.০৫%-এর কাছাকাছি বাংলাদেশে, যেখানে জনসংখ্যার অন্ততঃ ১০% হিন্দু।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ দাবী করেছে ২০১৯ সালের প্রথম চার মাসে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী। ওই একই সময়ে বাংলাদেশে মোট ধর্ষণের সংখ্যা ৩৯৬ নারী ও শিশু। তার অর্থ, ধর্ষণের শিকার যারা তাদের মধ্যে আন্দাজ ২% হলো হিন্দু।

উপরের দুইটা পরিসংখ্যানে কি মনে হয় যে বাংলাদেশের হিন্দুরা স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে বেশী নিগ্রহের শিকার হচ্ছে? মোটেই না। বরং সংখ্যাগুরু মুসলমানেরা বেশী সংখ্যায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশে। বলা হয় হিন্দুদের জমি দখল হয়। বাংলাদেশে কার জমি দখল হয়না? বাংলাদেশে তো খোদ সরকার নিজেই তার জমি পুলিস মিলিটারি দিয়েও রক্ষা করতে পারেনা। সে কার জমির সুরক্ষা দেবে?

দেশে কিছুটা আইনের শাসন না থাকলে কী সংখ্যালঘু কী সংখ্যাগুরু- কেউই তার সহায় সম্পত্তি রক্ষা করতে পারে না। আর দুর্বল হইলেতো কথাই নাই! আর আইনের শাসন না থাকলে জঙ্গলের শাসন জারি থাকে, এইটার পোশাকি নাম ‘ক্ষমতা’। ক্ষমতার দম্ভে জমি থেকে উচ্ছেদ হইয়া সংখ্যাগুরু মুসলমান ঢাকায় আইসা রিকসা চালায় আর সংখ্যালঘু হিন্দু বারাসাতে গিয়া মাছ বিক্রি করে খায়! তফাত শুধু এটুকু!

বলা হয় হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙ্গা হয়। এই প্রতিমা ভাঙা সংস্কৃতির উদ্ভবই তো আওয়ামী লীগের হাতে। আপনারা শুনলে অবাক হবেন পাকিস্তান আমলে এই ভুখণ্ডে কখনো হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙ্গা হয়নি। প্রথম প্রতিমা ভাঙ্গার ঘটনা ঘটে ১৯৭২ সালের দুর্গাপপূজার দ্বিতীয় দিনে খোদ ঢাকায়। যারা প্রতিমা ভেঙ্গেছিলো তারা চিহ্নিত হবার পরেও কারো শাস্তি হয়নি কারণ তারা সবাই রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ছিলো।

বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় ১২% সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। আর, ২৫% সরকারী চাকরী রয়েছে সংখ্যালঘুদের দখলে, উচ্চপদস্থ এক মন্ত্রীই জানিয়েছেন দু-দিন আগে। এই পরিসংখ্যান বলে দেয় যে হিন্দুরা বাংলাদেশে চাকরীর বৈষম্যের শিকার নয়।

বলা হয় হিন্দুরা দেশত্যাগ করে। কিন্তু কেন করে? এর কারণ তো নির্যাতন নয়। এর কারণ ‘হিন্দু জাতি’ ধারণা। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগেই এই ‘হিন্দু জাতি’র ধারণার উদ্ভব হয়। হিন্দু শব্দটা জাতি শব্দের সমার্থক হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে। এই হিন্দুত্বের ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন হিন্দুত্ববাদী আরএসএস সাভারকার। তিনি ‘হিন্দু’ শব্দকে ডিফাইন করেন ‘ভারতকে পবিত্রভুমি এবং পিতৃভূমি হিসেবে যারা বিবেচনা করে তারাই হিন্দু জাতি’।

এই হিন্দুত্বের জাতিকল্পনাই এক মারাত্মক দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার জন্ম দিয়েছে। কারণ বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে তাঁদের পিতৃভুমি এবং হোলি ল্যাণ্ড বিধায় পলিটিক্যাল এজেন্ট হিসেবে ভারত রাষ্ট্র একটা সম্ভাবনা হয়ে বিরাজ করতে থাকে। সেই ভারত রাষ্ট্রকেই তার ধর্মীয় ও জাতিগত পরিপূর্ণতার চুড়ান্ত ডেস্টিনেশন হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে।

কিন্তু এইসব কিছুই যা দিয়ে ‘হিন্দু নির্যাতন’ ডিফাইন এবং ব্যাখ্যা করা হয় সেটা কি রাষ্ট্র গঠনের সমস্যা নয়? সেই রাষ্ট্র গঠনের সমস্যাকে হিন্দু নির্যাতনের সমাধান হিসেবে স্যেকুলারেরা কিন্তু এড্রেস করেনা। এইজন্য রাষ্ট্রের মেরামতের জরুরী কর্তব্যকে সামনে নিয়ে আসেনা। এই হিন্দু নির্যাতনের মিথ ব্যবহার করা হয় সংখ্যাগুরু মুসলমানদের লজ্জা দেয়ার উপলক্ষ হিসেবে। প্রিয়া সাহার জমি নিয়ে শরিকদের সাথে গণ্ডগোলকেও তাই ইসলামী মৌলাবাদী হামলা বলে প্রিয়া সাহা পরিচয় করিয়ে দেয়।

‘একটা ঠিকঠাক রাষ্ট্র গড়া না গেলে আর হিন্দুরা হিন্দু পরিচয়ে বিশেষ সুরক্ষার দাবী না তুলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক পরিচয়ে ‘হিন্দু অধিকারের’ বদলে নাগরিক অধিকারের জন্য যতক্ষণ লড়াই না করতে পারবে ততদিন এই সমস্যার কোন সমাধান নেই’।