বিএনপির শূন্যপদগুলো পূরণ হচ্ছে

প্রকাশিত: ৪:২৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৮, ২০১৯
বিএনপির নির্বাহী কমিটির বৈঠক। ফাইল ছবি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অবিশ্বাস্য সাংগঠনিক দুর্দশা প্রদর্শনের পর দল গোছানোর দিকে মন দিয়েছে বিএনপি। গত এক দশক ধরে আন্দোলনের ডাক দিয়ে মাঠে না থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়া নেতাকর্মীদের ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব।

প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের ধরপাকড় ছিল সত্য; কিন্তু এর বিপরীতে বিএনপির মেরুদণ্ডহীন সাংগঠনিক চিত্র ধরা পড়েছে সবার চোখেমুখে। কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি দলটি।

এমনকি বহু কেন্দ্রে এজেন্টেই দিতে পারেনি দীর্ঘদিন নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে থাকা দলটি। সব মিলিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা বিএনপির।

সেই হতাশা কাটিয়ে দলকে সাংগঠনিকভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন কারাবন্দি হওয়ায় দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দল গোছানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। আগামী দিনে রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে মাঠে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য যা করা দরকার, সেই উদ্যোগ তিনি দূর থেকে নেবেন। সে জন্য সাংগঠনিকভাবে দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, নির্বাচনে ‘অবিশ্বাস্য’ বিপর্যয়ের পর বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে বিরাজ করছে হতাশা। এ অবস্থা থেকে দলকে বের করে আনতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। আপাতত দল গোছানোর লক্ষ্যে দ্রুত দলীয় ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি করতে চাইছেন তারা।

বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, হাজারও নেতাকর্মী রয়েছেন কারাগারে। এমন অবস্থায় নতুন করে দলের জাতীয় কাউন্সিল করার মতো পরিস্থিতি নেই। তাই এখন স্থায়ী কমিটি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ পূরণের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পরামর্শ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। অনুমতি পেলেই শূন্যপদগুলো পূরণ করা হবে।

সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করেছিল বিএনপি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় নির্বাহী কমিটি তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হবে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাহী কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত এ কমিটিই দায়িত্ব পালন করবে।

সূত্র জানায়, মঙ্গলবার গুলশান কার্যালয়ে নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে দলের জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে অলোচনা হয়। স্থায়ী কমিটির একজন সিনিয়র সদস্য বিষয়টি বৈঠকে তোলেন। তবে অন্য সদস্যদের এ ব্যাপারে আগ্রহ না থাকায় এ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়নি।

বৈঠকে বিএনপির নির্বাহী কমিটির শূন্যপদসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে এবার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা নির্বাচন হবে সরাসরি ভোটে এমন সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।

বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা যুগান্তরকে বলেন, দলের স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহাসচিবকে নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী সপ্তাহে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দেখা করবেন। সেই সময় বিএনপি নেতারা চেয়ারপারসনের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়েও আলাপ করার কথা রয়েছে।

পূরণ হচ্ছে ভাইস চেয়ারম্যান-উপদেষ্টার শূন্যপদ

আগাম এক মাসের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের শূন্যপদগুলো পূরণ করা হবে।

৩৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে কমিটি ঘোষণার পর পরই পদত্যাগ করেন মোসাদ্দেক আলী ফালু। ইনাম আহমেদ চৌধুরী দলত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাদের মধ্যে রয়েছেন টিএইচ খান, অধ্যাপক আবদুল মান্নান প্রমুখ। তারা দলীয় বৈঠকে অংশ নিতে পারছেন না। তাদের বাদ না দেয়া হলেও শূন্যপদে সাংগঠনিক সম্পাদক কিংবা যুগ্ম মহাসচিব বা উপদেষ্টামণ্ডলী থেকে কাউকে কাউকে প্রমোশন দেয়া হতে পারে।

দলটির ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির বেগম সরোয়ারি রহমান, হারুনার রশিদ খান মুন্নু, ফজলুর রহমান পটোলসহ সাতজন মারা গেছেন। তাদের স্থলে ত্যাগী, পোড় খাওয়া ও সিনিয়র নেতাদের আনা হবে।

নির্বাহী কমিটিতে সংস্কার

নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র ও সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদ দুটি কমিটি ঘোষণার পরই ফাঁকা। নির্বাহী কমিটির সাতটি আন্তর্জাতিক সম্পাদকের মধ্যে দুটি ফাঁকা।

সহ-যুববিষয়ক সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হলেও যুববিষয়ক সম্পাদকের পদটি এখনও ফাঁকা। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যে মারা গেছেন চারজন।

নির্বাহী কমিটির সদস্য নূর মোহাম্মদ মণ্ডল দলত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এসব ফাঁকা পদে নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। তাদের স্থলে ছাত্রদল, যুবদল ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের সাবেক নেতাদের আনা হতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণ হচ্ছে

বিএনপিতে স্থায়ী কমিটি বরাবরই একটি আকর্ষণীয় ও মর্যাদাসম্পন্ন পদ। আজীবন বিএনপির রাজনীতি করা পোড় খাওয়া নেতাদের টার্গেট থাকে শেষ জীবনে হলেও স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এ ফোরামে সাংগঠনিকভাবে যোগ্য, পরীক্ষিত, ত্যাগী ও দলে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরই স্থান হয়। তাই প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া।

এ কমিটি নির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত, কর্মসূচি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজগুলো করে। স্থায়ী কমিটির সুপারিশের আলোকেই বেশিরভাগ সময় বিএনপির শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। অন্তত খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে।

গত কমিটি ঘোষণার সময়ই ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির দুটি পদ ফাঁকা ছিল। বাকি ১৭ সদস্যের মধ্যে তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও এমকে আনোয়ার মারা গেছেন। ফলে বর্তমানে পাঁচটি পদ ফাঁকা। লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া অসুস্থতার কারণে নিয়মিত সময় দিতে পারছেন না। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ কমিটি ঘোষণার আগে থেকেই ভারতের শিলংয়ে আছেন। তিনি কমিটির একটি বৈঠকেও যোগ দিতে পারেননি।

সূত্র জানায়, মঙ্গলবার গুলশান কার্যালয়ে নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে দলের জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে অলোচনা হয়। স্থায়ী কমিটির একজন সিনিয়র সদস্য বিষয়টি বৈঠকে তোলেন। তবে অন্য সদস্যদের এ ব্যাপারে আগ্রহ না থাকায় এ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়নি।

বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা যুগান্তরকে বলেন, দলের স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহাসচিবকে নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী সপ্তাহে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দেখা করতে পারেন। সে সময় চেয়ারপারসনের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়েও আলাপ করার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার কথা ভাবছেন। এ নিয়ে ওই দুই নেতা তাদের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথাও বলেছেন।

সব মিলিয়ে স্থায়ী কমিটিতে সাতটি পদ ফাঁকা হচ্ছে। এসবের অন্তত পাঁচটিতে নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। বাকি দুটি পদ ফাঁকাই রাখা হতে পারে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির শূন্যপদে আসতে পারেন বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, সেলিমা রহমানের মতো প্রবীণ নেতারা।

একটি পদে জিয়া পরিবারের সদস্য ও তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমানের অন্তর্ভুক্তির দাবি রয়েছে বিভিন্ন পর্যায় থেকে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হওয়া ক্লিন ইমেজের ডা. জোবায়দা দলকে গোছাতে পারবেন বলে ধারণা অনেকের।

গতবার কাউন্সিলের আগে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনায় ছিলেন প্রবীণ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। আলোচনায় ছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ও ড. ওসমান ফারুক। এ দুজনই এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাই শূন্যপদে তাদের কারোরই অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা নেই।

ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টামণ্ডলী থেকে অন্তত দুজনকে স্থায়ী কমিটিতে আনা হবে। চট্টগ্রামের প্রবীণ বিএনপি নেতা এম মোরশেদ খান ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান জিয়া পরিবারের বিশ্বস্ত। তাদের কোনো একজনকে দেখা যেতে পারে স্থায়ী কমিটিতে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম চাচ্ছে দূরদর্শী ও মাঠে থাকার মতো নেতারা স্থায়ী কমিটিতে আসুক। সেই বিবেচনায় দুজন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী নেতাকেও এ পদে অন্তর্ভুক্ত করার কথা উঠছে।