নির্বাচন হয় জোটবদ্ধ, সরকার গঠন করে আ’লীগ: সমাধান চায় ১৪ দল

প্রকাশিত: ৫:০০ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১৬, ২০২২
ছবি: পিআইডি

আওয়ামী লীগের একক সরকার গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ১৪ দল। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সেটি আলোচনা করে নেওয়ার কথা বলেছেন জোট নেতারা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১৪ দলের সম্পর্ক নিয়ে (টানাপোড়েন) উত্থাপিত প্রশ্নের সমাধানও চাইছেন তারা। তবে আগামী নির্বাচন জোটগতভাবে করার বিষয়ে সম্মত তারা। নেতাদের দাবি, যে কোনোভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ ও রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যায় কি না, সেটি ভেবে দেখতে হবে।

  • রেশনিং ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ

  • ১৪ দলের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন

দীর্ঘ দুই বছর পর বৈঠক করেছে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে মঙ্গলবার গণভবনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এদিন বেলা সাড়ে ১১টায় বৈঠক শুরু হয়ে শেষ হয় বিকেল তিনটায়। বাংলাদেশ জাসদ ছাড়া ১৪ দলের সব শরিক দলের নেতারা এতে অংশ নেন। দীর্ঘ সময় ধরে বেশ খোলামেলা আলোচনা হয় বৈঠকে।

দীর্ঘদিন পরের এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নানা বিষয় তুলে ধরেন শরিক দলের নেতারা। তাদের আলোচনায় সরকার গঠন, জোটের সম্পর্ক জোরদার, জোট শক্তিশালীকরণ ও কর্মসূচির বিষয়গুলো উঠে আসে। পাশাপাশি চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানারও পরামর্শ আসে। দরিদ্র্য ও মধ্যবিত্তের সংকট সমাধানের কথা হয়। রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যায় কি না, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ আসে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাংলাদেশের অবস্থান নিয়েও কথা হয় বৈঠকে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন ও সরকার গঠন নিয়ে ১৪ দলের নেতারা বলেছেন, গতবার আমরা ১৪ দলের জোটের ভিত্তিতে নির্বাচন করলাম, কিন্তু সরকার হলো আওয়ামী লীগের। এটা কিভাবে সম্ভব? এটা আলোচনার ভিত্তিতে যদি হত, তাহলে আমাদের (১৪ দলের) আপত্তি ছিল না। কিন্তু একতরফাভাবে যে আওয়ামী লীগ বলে দিলো- সরকার হবে আওয়ামী লীগের। তাহলে ১৪ দলের ভিত্তিতে নির্বাচন করার কী যৌক্তিকতা আছে?

জোট নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, ফজলে হোসেন বাদশাসহ অনেকে কথা বলেছেন বলে বৈঠক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে নেতারা বলছেন, এ নিয়ে উত্তেজনাকর আলোচনা হয়নি। ধীরস্থিরভাবে পর্যালোচনার জন্য আলোচনায় আসছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই যেন সেই ব্যাপারটা আলোচনা করে নেওয়া হয়- সেটা বলা হয়েছে। সরকার আওয়ামী লীগের হবে, নাকি ১৪ দলের? পরিষ্কার হওয়া দরকার।

এ বিষয়ে একাধিক নেতা জাগো নিউজকে বলেন, কেবলমাত্র আলোচনা শুরু হয়েছে। জোট দু’বছর নিস্ক্রিয় ছিল, বৈঠক হয়নি। সূত্রপাত হলো আলোচনার। আরও আলোচনা হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদ যে ভোটের ব্যবস্থা করেছিলো সেখানে বাংলাদেশ ভোট না দেওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে ১৪ দলের জোটের নেতারা। তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত ছিলো সময়োপযোগী ও দূরদর্শী। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এটাই আমাদের নীতি।

বৈঠকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, গণ-আজাদী লীগ নেতা এসকে শিকদার চলমান দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তারা বলেন, করোনাকালের মতো সংকট প্রধানমন্ত্রী উত্তরণ ঘটিয়েছেন। সে বিবেচনায় দ্রব্যমূল্যের বিষয়টির দিকে তিনি নজর দিলে দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এটি শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে। কোনো সংকট হবে না। এক কোটি মানুষ ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য কিনতে পারবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।

বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন ১৪ দল জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন নেতারা। এ সময় সব দলকে আরও বেশি সক্রিয় ও সংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

বৈঠকে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া অথবা সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধানের অংশ না নেওয়ার বিষয় উঠে আসে। একজন বলেছেন, বাংলাদেশ জাসদ অন্য একটি জোটে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তবে এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বলতে বেশি আগ্রহ দেখাননি বলে বৈঠক সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে ১৪ মার্চ বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া জাগো নিউজকে বলেন, আমরা জানি প্রধানমন্ত্রী ১৪ দলের বৈঠক ডেকেছেন। তবে বৈঠকে যাচ্ছি না। আমরা পুরোনো অবস্থানে আছি। ১৪ দলে আর কন্টিনিউ করছি না। গণতন্ত্রের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নতুন উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করি। সেজন্য কাজ করছি।

বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা জাগো নিউজকে বলেন, ১৪ দল এতদিন নিষ্ক্রিয় হয়েছিল। সেটা সক্রিয় করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে জোটকে সংগঠিত করার তাগিদ এসেছে। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচন ঐক্যবদ্ধভাবে করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, দরিদ্র্য ও মধ্যবিত্তের সংকট নিয়ে কথা হয়েছে। রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যায় কি না, তার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে সরকারকে আমরা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন, যে কোনোভাবেই হোক- দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। এজন্য যা করা দরকার, সরকার সেটা করবে। তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কিছু পণ্যের ভ্যাট ট্যাক্স আজই তুলে দিয়েছে। বাজার মনিটরিংয়ের জন্য ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, বৈঠকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, জোট সক্রিয়করণ, দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচন জোটগতভাবে হবে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা কথা বলেছি, যেভাবে হোক দ্রব্যমূল্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। এছাড়াও জোটের কর্মকাণ্ড বাড়ানো ও জনগণের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে কথা হয়েছে। জেলায় জেলায় সফরের বিষয়ে কথা আসছে।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ১৪ দলীয় জোটের ঐক্য, বর্তমান পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য সব বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। বহুদিন পরে একটা ভালো আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, সরকারের সঙ্গে ১৪ দলের সম্পর্কে যে প্রশ্নটা আছে, সেটাও আপনার নির্মূল করতে হবে। কারণ সব ব্যাপারে আমরা একমত নই। সব বিষয় আমরা মেনে নিয়েছি ব্যাপারটা এ রকম নয়। সুতরাং যেখানে যেটা আছে, সেখানে কোনো ব্যত্যয় থাকলে, বিষয়টি আলোচনায় আসে।

এদিকে বৈঠকের পরে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু। তিনি বলেন, ১৪ দলের সঙ্গে ঐক্য বজায় থাকবে। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করা হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের মোকাবিলায় ১৪ দলের যে ভূমিকা সেটিও অব্যাহত থাকবে।

বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তখন কি জোটবদ্ধ নির্বাচন হবে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আমু বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা তারা বলছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী করবে, এটা দেখার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেব।

বিএনপির দেশব্যাপী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ১৪ দল মাঠে নামবে জানিয়ে আমু বলেন, বিএনপির আন্দোলনের বিরুদ্ধে ১৪ দল মাঠে নামবে। প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দেবেন। সে অনুযায়ী ১৪ দলকে ঐক্যবদ্ধ করে কাজ শুরু করা হবে।

বৈঠক শেষে সদ্য প্রকাশিত রাশেদ খান মেননের আত্মজীবনী ‘এক জীবন: স্বাধীনতার সূর্যোদয়’- এর প্রথম পর্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন।