করোনায় জামাআত-জুমআ নিয়ে দেশের শীর্ষ আলেমদের মতামত

প্রকাশিত: ৩:১৯ পূর্বাহ্ণ, মে ২২, ২০২০

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বিশ্বের অনেকে দেশের মসজিদে জামাআত বন্ধ রয়েছে। মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে জামাআত ও জুমআ আদায়ে করণীয় ঠিক করতে ধর্মমন্ত্রণালয় আলেম-ওলামাদের পরামর্শ গ্রহণ করে। পরামর্শক্রমে মন্ত্রণালয় মসজিদের পাঞ্জেগানা জামাআতে ৫ জন এবং জুমআ জামাআতে ১০ জনকে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম। তাদের সে বক্তব্যগুলো তুলে ধরা হলো-

আল্লামা শাহ আহমদ শফী

করোনায় মসজিদে জামাআত ও জুমআয় উপস্থিতি সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে তিনি যথার্থ ও সঠিক বলেছেন। তিনি কুরআন-সুন্নাহর বিবৃতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন-
– আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে ঘোষণা করেন-
وَلاتَقْتُلُواأَنفُسَكُمْ إنَّ للَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চিত জেন রেখো, আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সুরা নিসা : আয়াত ২৯)

– অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেন-
ولاتُلْقُوابأيْدِيكُم إلى التهْلُكة
তোমরা নিজ হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৫)
– আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন-
يَاأَيُّهَاالَّذِينَ آَمَنُواخُذُواحِذْرَكُمْ
হে ঈমানদাররা! তোমরা (শত্রুর সাথে লড়াইকালে) আত্মরক্ষার উপকরণ নিজেদের সাথে রাখো।’ অর্থাৎ আত্মরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করো।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৭১)

অতপর তিনি দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে নসহিত তুলে ধরেন-
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পুরো বিশ্ব। আমাদের দেশও বর্তমানে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। করোনাভাইরাসের বর্তমান চিত্র খুবই ভয়াবহরূপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে এ ভাইরাস আমাদের দেশেও মহামারি আকার ধারণ করছে। সর্বত্র দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্তদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করছেন। এ মুহূর্তে আল্লাহর কাছে দোয়া এবং শরিয়তের আলোকে সতর্কতা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, সরকার ইতিমধ্যে যেকোনো ধরনের বড় জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আদেশ দিয়েছে। নামাজের জামাআত ও জুমআর উপস্থিতিও সীমিত রাখার আদেশ জারি করেছে। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতেও এসব সতর্কতামূলক নির্দেশনা সঠিক ও যথার্থ।

 

সরকার কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনাকে মূল্যায়ন করা এবং তা উত্তমরূপে গ্রহণ ও পালন করা মানবতার কল্যাণে আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

শুধু সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণই আমাদের একমাত্র কাজ নয়, দাবি করে তিনি নসিহত পেশ করে বলেন-
আমাদের কৃতপাপ ও অন্যায়সমূহ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহর রহমত তথা অনুগ্রহ লাভে সব অপরাধ থেকে বিরত থাকার নিয়তে খাঁটি তাওবা করতে হবে।

ঘরে বসে দোয়া, ইসতেগফার, নফল ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে। যেন আল্লাহ তাআলা অনতিবিলম্বে আমাদের থেকে বৈশ্বিক এ মহামারি তুলে নেন। নিরাপদে জীবন যাপন করার তওফিক দান করেন। আমাদেরসহ সারাবিশ্বকে এ মহামারি থেকে মুক্তি দেন।

মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ
মহামারি করোনার ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে মসজিদে জামাআত ও জুমআ আদায়ের সরকারি সিন্ধান্ত ঘোষণার পর এক ভিডিও বক্তব্যে মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ এ আয়াত দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৫৯)

তিনি বলেন, মসজিদে নামাজ আদায় কালে যদি যথাযথ দূরত্ব বজায় না রাখা যায় তবে তা সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। আর ধর্মীয় কাজে মসজিদ থেকে যদি তা সংক্রমণ হয় তবে এ বিষয়টি প্রচার প্রচারণায় ব্যাপক আকার ধারণ করবে। সুতরাং করোনার এ কঠিন মূহূর্তে তা থেকে উত্তরণ একমাত্র উপায় হলো রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা জারি করা।

তিনি আরও বলেন, সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, আর তা যদি শরিয়তের আলোকে হয় তবে ওলামায়ে কেরাম তা মেনে নিতে পারে। কিছু কিছুবিষয় এমন আছে যেগুলো ফিকহি ফতোয়ার নীতিমালা তথা মাসআলা। সরকার যদি সে নীতিমালা গ্রহন করে তবে তা শরিয়তেও গ্রহণযোগ্য হয়। সব কিছু ওলামায়ে কেরাম, মুফতিদের ওপর নির্ভর নয়, বরং সরকারকেই শরিয়তের আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়।

তিনি বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ২৯ মার্চের বৈঠকের আলোচনায় আমরা বেশ কিছু লোককে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছি এবং কিছু সংখ্যক লোককে শর্ত সাপেক্ষে আমরা মসজিদে যেতে উৎসাহিত করেছি।

সরকারের ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন-
‌মসজিদে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোককে মসজিদে আসার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেয়া কোনো সাধারণ নিয়মে আসে না। তবে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান বা দায়িত্বশীল যদি জনগণের কল্যাণে দেশ ও জাতীর কল্যাণে মসজিদে মুসল্লির উপস্থিতির ব্যাপারে সীমিত সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়, তখন সেটা শরিয়তের আলোকে গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।

তিনি বলেন, বিষয়টি অনেকের না জানা কারণে এ নির্দেশনার ব্যাপারে নানা মন্তব্য করে থাকেন। সুতরাং ধর্মমন্ত্রণালয় থেকে যে নোটিশ এসেছে তা মেনে পাঞ্জেগানা মসজিদে ৫ জন এবং জুমআ মসজিদে ১০ জন নামাজ পড়বে। এ বিষয়টি আমরা আগেও বলেছি সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় তবে তা পালনে কোনো শরিয়তে বিরোধ নেই।

তিনি আরও বলেন, আবেগে চলার কোনো বিষয় নয় বরং ইসলাম হচ্ছে সহজ। দ্বীন মেনে সহজ জীবন যাপন করাই শ্রেয়। এ প্রসঙ্গে কুরআন-সুন্নাহর অনেক নির্দেশনা রয়েছে। সুতরাং সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ঘরে নামাজ আদায় করতে এবং মসজিদে পাঞ্জেগানায় ৫ জন এবং জুমআয় ১০ জনের উপস্থিতিতে নামাজ আদায়ের প্রতিও তিনি আহ্বান জানান।

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন
মহামারি করোনার ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে মসজিদে জামাআত ও জুমআ আদায়ের সরকারি সিন্ধান্ত ঘোষণার পর এক ভিডিও বক্তব্যে মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ এ আয়াত দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন-
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّن مَّنَعَ مَسَاجِدَ اللّهِ أَن يُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ وَسَعَى فِي خَرَابِهَا أُوْلَـئِكَ مَا كَانَ لَهُمْ أَن يَدْخُلُوهَا إِلاَّ خَآئِفِينَ لهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَلَهُمْ فِي الآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ
যে ব্যাক্তি আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে উজাড় করতে চেষ্টা করে, তার চাইতে বড় যালেম আর কে? এদের পক্ষে মসজিদসমূহে প্রবেশ করা বিধেয় নয়, অবশ্য ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়। ওদের জন্য ইহকালে লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১১৪)

গত ২৯ মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আয়োজিত ধর্মমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বৈঠকে গৃহীত মসজিদে জামাআত ও জুমআ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মসজিদে নামাজের আবাদ অব্যাহত রাখা ফরজে কেফায়া। মসজিদে জামাআত পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। তবে ফরজে কেফায়া আদায়ের লক্ষ্যে যে কয়জন মানুষের প্রয়োজন তাদের নিয়ে জামাআত আদায় অব্যাহত রাখতে হবে।

ছাড়া ২ জন ব্যক্তি উপস্থিত থাকলে এবং জুমআয় ইমাম ছাড়া ৩ জন উপস্থিত হল ফরজে কেফায় আদায় হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে মসজিদে মুয়াজ্জিন ও খাদেমসহ পাঞ্জেগানায় ৩ জন এবং জুমআয় ৪ জন হলেই জামাআত আদায় হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকার যদি মসজিদে নামাজ সংক্ষিপ্ত আকারে জমাআত ও জুমআ সম্পাদনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাতে শরিয়তে কোনো বাধা নেই।

তিনি আরও বলেন, ‌করোনার মুসিবত থেকে মুক্তি পেতে সব অবাধ্যতা ফিরে এসে আল্লাহর কাছে তাওবা ও ইসতেগফার কথাও বলেন।

উল্লেখ্য, ধর্মমন্ত্রণালয় দেশের প্রখ্যাত আলেম-ওলামাদের নিয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক দেশের সব মসজিদে পাঞ্জেগানায় ৫ জন এবং জুমআ মসজিদে ১০ জনের উপস্থিতিতে নামাজ পড়ার ঘোষণা দেয়। ইসলামি শরিয়তের আলোকে তা আদায়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।