সমঝোতার চেষ্টা ও বিরোধের প্যাঁচে জাপা

প্রকাশিত: ২:৪৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৯

বিরোধ মেটাতে ও দলে ভাঙ্গন ঠেকাতে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) কলহে লিপ্ত দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা এবং রংপুর-৩ আসনে উপ-নির্বাচনে এরশাদ-রওশনের ছেলে রাহগির আল মাহির (সাদ এরশাদ) দলীয় প্রার্থী’- এই তত্ত্ব নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। সমঝোতার লক্ষ্যে রওশন ও কাদের বলয়ের কয়েক নেতা গতকাল শনিবার রাতে রাজধানীর একটি ক্লাবে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে ছিলেন- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উভয় পক্ষের এরকম দুইজন করে চারজন নেতা পৃথকভাবে টাইমস বিডিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এরমধ্যেও কিছু কিছু ইস্যুতে দুই পক্ষের বিরোধের তেজ এখনও কমেনি। রওশন-কাদের পন্থিদের কেউ কেউ পরস্পরের বিরুদ্ধে এখনও তোপ দাগাচ্ছেন। সবমিলিয়ে প্রয়াত এইচএম এরশাদের রেখে যাওয়া দলটি এখনও গ্যাড়াকলেই।

 

গতকাল রাতের এই সমঝোতা বৈঠকে জিএম কাদেরের পক্ষে ছিলেন- দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি ও লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। আর রওশন বলয়ের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, ফখরুল ইমাম এমপি, এসএম ফয়সল চিশতি ও সেলিম ওসমান এমপি। জিয়াউদ্দিন বাবলু ও আবু হোসেন বাবলা দুজনই গতকাল জানান, তারা দলের ঐক্য চান, এজন্যই সমঝোতার চেষ্টা করছেন।

গত চারদিন ধরে জাপার নেতা-কর্মীদের চোখের আড়ালে থাকা দলটির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাও চলমান দ্বন্দ্বের অবসানের আশা দেখছেন। চারদিন ধরে তেমন কারও ফোন না ধরলেও গতকাল এই প্রতিবেদকের প্রথম কলেই ফোন রিসিভ করেন রাঙ্গা। বললেন, ‘কৌশলগত কারণে রাজনীতিতে কখনও কখনও ডুব দিতে হয়। আমি যদি রওশন এরশাদ বা জিএম কাদের কারও প্রোগামে অংশ নিতাম তাহলে মনে হতো আমি একটা পক্ষ নিয়েছি। আমি সেটি চাইনি বলেই চুপ ছিলাম। তবে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করছি। আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যেই সমঝোতা হবে।’ জানা গেছে, আজ রবিবার জাপার বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে পারেন রাঙ্গা।

সমঝোতার উদ্যোগের ইঙ্গিত দিয়েছেন জাপার চেয়ারম্যান দাবিদার জিএম কাদেরও। গতকাল দুপুরে রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির (জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য এয়ার আহমদ সেলিমের জাপায় যোগদান অনুষ্ঠানে জিএম কাদের বলেন, ‘পদ-পদবি বা ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের জন্য আমি রাজনীতি করি না। দেশ, দেশের মানুষ ও জাপার জন্য আমাদের রাজনীতি। কোনো লোভ-লালসার জন্য আমাদের রাজনীতি নয়। দল গঠনতন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের নির্দেশনায় চলছে। জাপায় বিভেদের অবকাশ নেই। বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই এখানে। বিশৃঙ্খলার সুযোগ জাপায় থাকবেনা। সঠিক পথে ও সুশৃঙ্খলভাবে জাপা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এগিয়ে যাবে। ঐক্যের মাধ্যমে আমরা সবাই মিলে দলকে সামনে এগিয়ে নিতে চাই। ঐক্যের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে আমি প্রস্তুত।’ এসময় আগামী ৩০ নভেম্বর জাপার কাউন্সিল হবে বলে ঘোষণা করে জিএম কাদের বলেন, ‘সম্মেলনে দলের নেতা-কর্মীরাই জাপার আগামী দিনের নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। যে কেউ চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। নেতা-কর্মীদের সিদ্ধান্তই আমি মেনে নেব।’

সমঝোতার চেষ্টার কারণেই গতকাল রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের কোনো পক্ষই রংপুর-৩ আসনে দলীয় প্রার্থীর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। শুক্রবার বনানী কার্যালয়ে জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যদের যৌথসভায় রংপুর মহানগর জাপার সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াছিরকে দলের প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। গতকাল তার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার কথা ছিল। তবে সেটি স্থগিত করেন জিএম কাদের। এছাড়া শুক্রবারের ওই যৌথসভায় সর্বস্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল যে- রওশনের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেওয়া দলের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও ফখরুল ইমামকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। গতকাল সেই অব্যাহতির ঘোষণা দেওয়ারও কথা ছিল, সেটিও স্থগিত রেখেছেন জিএম কাদের। রওশনপন্থিদেরও প্রস্তুতি ছিল- যদি আনিস ও ফখরুলকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তাহলে তারাও দল থেকে জিএম কাদেরকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেবেন। এই বিষয়টি ছাড়াও সাদকে রংপুরে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণার জন্য গতকাল বিকালে রওশন গ্রুপের সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল। সমঝোতার চেষ্টা চলায় রওশনও সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করেন।

এদিকে, আজ বিকাল পাঁচটায় শুরু হচ্ছে সংসদের চতুর্থ অধিবেশন। এর আগে ‘বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন’ করতে আজ বেলা ১টায় সংসদ ভবনে দলের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক ডেকেছেন জাপার চেয়ারম্যান দাবিদার রওশন এরশাদ। দলের বর্তমান ২৫জন সংসদ সদস্যের মধ্যে জিএম কাদেরসহ বাকি ২৪ জনকেই বিরোধীদলীয় উপনেতার প্যাডে নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান উল্লেখ করে গতকাল চিঠি পাঠিয়েছেন রওশন। জিএম কাদেরকে দেওয়া চিঠিতে তাকে জাপার কো-চেয়ারম্যান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে রওশনের ডাকা আজকের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে কাদেরের প্রতি সমর্থন থাকা এমপিদের। দলের ১৫ জন এমপি ইতোমধ্যে স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে কাদেরকে সমর্থন জানিয়েছেন। জিএম কাদের তাকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নিয়োগের জন্য মঙ্গলবার সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে যেই চিঠি দিয়েছেন সেটির সঙ্গে ওই ১৫ এমপির স্বাক্ষরও সংযুক্ত করেছেন। এছাড়া আজ যখন রওশন পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক ডেকেছেন, এর আগে বেলা ১২টায় জিএম কাদের বনানী কার্যালয়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এমপিদের যৌথসভা ডেকেছেন।

রওশনের আজকের বৈঠকে যোগ না দেওয়ার যুক্তি দেখিয়ে জিএম কাদেরের প্রতি সমর্থন থাকা জাপার চারজন এমপি গতকাল জানান, দলের চেয়ারম্যান হিসেবে তারা জিএম কাদেরকেই মানেন। চেয়ারম্যান হিসেবে কাদেরই জাপার পার্লামেন্টারি পার্টির প্রধান। সুতরাং পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক ডাকার এখিতয়ারও কাদেরের। তাছাড়া জাপার গঠনতন্ত্রের ২২ ধারায় বিরোধীদলীয় নেতা মনোনয়নে পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক করার কোনো কথা বলা হয়নি।

জাপার কাদেরপন্থি একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, রংপুর উপনির্বাচনে রওশনপুত্র সাদকে দলের মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে তাদের ঘোর আপত্তি রয়েছে। রংপুরের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফাসহ স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও সাদের বিরুদ্ধে একাট্টা। ফলে সাদের প্রশ্নে মতৈক্যে পৌঁছানো কঠিন। এছাড়া কাদেরপন্থিদের কেউ কেউ রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতা মানতে নারাজ। আবার রওশনের পক্ষে থাকা নেতাদের কেউ কেউও কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান মানতে রাজি নন। ফলে সমঝোতার চেষ্টা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে উভয় পক্ষের নেতাদের মধ্যেই। সংশয় প্রকাশকারী নেতাদের কারও কারও মতে, যেই তত্ত্বের কথা শোনা যাচ্ছে- সেই ফর্মুলায় সমঝোতা হলে রওশন ও কাদের দুজনই নিজ বলয়েই নতুন সংকটে পড়তে পারেন।

অন্যদিকে, গতকাল বনানী কার্যালয়ে যোগদান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বকারী জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, জাপার ওপরে বারবার আঘাত এসেছে। নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই জাপা এগিয়ে যাচ্ছে। এরশাদ দুইবার পাঁচটি করে আসনে জয়ী হয়েছেন, এটা ইতিহাস। গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা মোতাবেক এরশাদ তার অবর্তমানে জিএম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছেন। এটা গঠনতন্ত্র মোতাবেকই হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রওশন এরশাদ আমাদের মায়ের মতো, তিনি আমাদের অভিভাবক। আমরা বিশ্বাস করি কিছু মানুষের পরামর্শে বেগম রওশন এরশাদকে বিভ্রান্ত করা যাবেনা। রওশন এরশাদ অবশ্যই অনুধাবন করবেন এবং জাপার এগিয়ে চলার রাজনীতিতে আমাদের অভিভাবক হয়েই থাকবেন। চলমান বিদাদের সময়ে নিরব থাকা জাপার সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার গতকাল বলেন, ‘প্রায় সারাজীবন দলটা করি। বিপদে-আপদে কখনও এরশাদকে ছেড়ে যাইনি। এখন এরকম ঘটনায় কষ্ট পাচ্ছি। স্যারের (এরশাদের) আত্মাও হয়তো কষ্ট পাচ্ছে। নেতা-কর্মীরাও বিভ্রান্ত, দিশেহারা। আমি মনেপ্রাণে দলের ঐক্য কামনা করি।’