শিগগিরই প্রকাশ পেতে পারে বিডিআর বিদ্রোহের পূর্ণাঙ্গ রায়

প্রকাশিত: ১২:৪৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৬, ২০২০

বহুল আলোচিত বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় প্রায় দুই বছর আগে হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়নি এখনও। তবে শিগগিরই রায় প্রকাশ পাবে বলে সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে। চলতি মাসের প্রথম দিকে বা মাঝামাঝি সময়ে এ রায় প্রকাশ করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, বিশ্বে আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে আসামির দিকে থেকে বেশি এবং রায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামির সংখ্যাও বেশি। এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আাসামিদের করা আপিলের ওপর শুনানি নিয়ে রায়ও ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘদিন দেশি-বিদেশি মামলার রায় পর্যালোচনার পর আলোচিত এ মামলায় হাইকোর্টের রায় লেখা শেষ হয়েছে। এখন সর্বশেষ বৃহত্তর বেঞ্চের বিচারকরা তাদের স্বাক্ষরের পর তা প্রকাশ করা হবে।

 

হাইকোর্টের বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৃহত্তর বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর এ রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্ট তার রায়ে ১৩৯ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড (ফাঁসির আদেশ), ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বাকি ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।

 

আদালত সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা সম্পন্ন হয়েছে। তবে এই রায়ে কোনো ভুলত্রুটি রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কত সময় লাগবে তা উল্লেখ না করা হলেও চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন অথবা আরও সপ্তাহখানেক সময় লাগতে পারে। এই রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে ছয় বছর আগে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালতের দেয়া রায় অনুমোদন প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে।

জানা গেছে, এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি মো. শওকত হোসেন মূল রায় লিখেছেন। তিনি প্রায় সাড়ে ১১ হাজার পৃষ্ঠার রায় লিখে বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতির কাছে পাঠান। এরপর বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী পৃথকভাবে তার অংশ লিখেছেন। তিনিও প্রায় ১৬ হাজার পৃষ্ঠা লিখেছেন। এই দুই বিচারপতির সম্মিলিত রায় ২৭ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠা। এরপর সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার লিখেছেন সাড়ে ৫০০ পৃষ্ঠার ওপর। এই তিনজনের লেখা রায় এককরে তা চূড়ান্ত করার পর প্রকাশ করা হবে।

রায় প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও বড় মামলায় বিচার-কার্যক্রম শেষে বিচারিক আদালতের পর হাইকোর্ট থেকেও রায় ঘোষণা করা হয়েছে, এটা বিচার বিভাগের সফলতা বলে আমি মনে করি।

 

এটা একটা বড় অর্জনও বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। রায় প্রকাশের বিষয়ে তিনি বলেন, শুনেছি রায় লেখা চলছে। রায় লেখার পর পর্যালোচনা এবং বিচারকদের স্বাক্ষরের পরপরই এটি প্রকাশ করা হবে।

এ মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান এ প্রতিবেদককে বলেন, পিলখানা হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিলের ওপর সংক্ষিপ্ত একটা রায় (সর্ট অর্ডার পোষণ) ঘোষণা করা হয়েছে। এখন আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় রয়েছি। কারণ যারা দণ্ড পেয়েছেন তারা এই রায়ের কপি পাওয়ার পর আবার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবেন।

রায় প্রকাশের বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, সম্ভবত চলতি মাসের ১৫ তারিখের আগেই সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের একজন বিচারপতি অবসরে চলে যাবেন। তিনি অবসরে যাওয়ার আগেই রায়ে স্বাক্ষর করে যাওয়ার কথা। সে হিসেবে কাছাকাছি সময়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের একট সমূহসম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি বলেন, আমার ধারণা হাইকোর্টের রায় লেখা শেষ পর্যায়ে। বেঞ্চের সিনিয়র দুই বিচারপতি তাদের অংশ লিখে কনিষ্ঠ বিচারপতির কাছে পাঠিয়েছেন। তার লেখা শেষ হলেই প্রকাশ করা হবে। এই রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন হয়ে যাবে ফাঁসির রায়।

তিনি আরও বলেন, প্রায় দুই বছর আগে সংক্ষিপ্ত রায় দিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন করেছেন হাইকোর্ট। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকতা করা যাচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী এই রায় প্রকাশের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রায়ের কপি সরবরাহ করা হবে। কারা কর্তৃপক্ষ তা পড়ে শোনাবে। এরপর কোনো আসামি যদি আপিল করতে চান তবে সে সুযোগ থাকবে। কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হলে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি লাগবেই।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, এটা ছাড়াও আরও একটি বিষয় হলো, এ রায় প্রকাশিত না হওয়ার কারণে হাইকোর্টের রায়ে যারা খালাস পেয়েছেন বা যাদের কম সাজা হয়েছে তারা রায়ের সুবিধা পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, এই মামলার কোনো কোনো আসামি বিস্ফোরক আইনের মামলাও আসামি। রায়ের কপি না পাওয়ার কারণে হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্তরা বিস্ফোরক মামলায় জামিন আবেদন করতে পারছেন না। একইভাবে যাদের ইতোমধ্যে সাজা খাটা হয়ে গেছে তারাও মুক্তি পাচ্ছেন না। ফলে কোনো কোনো আসামি অহেতুক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আশা করব এ মামলায় দ্রুত রায়ের কপি প্রকাশিত হবে এবং খালাসপ্রাপ্তরা কারাগার থেকে বের হয়ে মুক্তি পাবেন।

কী হতে পরে রায় প্রকাশের পরবর্তী প্রক্রিয়া

নিয়ম অনুযায়ী হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন আসামি ও রাষ্ট্র উভয়পক্ষই। এরপর আপিলের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করা হবে। যদিও আপিল বিভাগের রায়ের পর ওই রায়ের রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

বিডিআর থেকে বিজিবি

এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ‘বিডিআর’ নামটি পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামকরণ করা হয়েছে।

নৃংশস হত্যার কালো দিন

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের সদরদফতর পিলখানা রক্তে রঞ্জিত করে একই বাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্য। তাদের হাতে দেশের মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে প্রাণ দিতে হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় দুটি ভাগে বিচার কাজ চলছে। এরই মধ্যে হত্যার বিচার শেষ পর্যায়ে। হত্যার অভিযোগে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে বিচার সম্পন্ন হয়েছে। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

পিলখানা হত্যা মামলা লালবাগ থেকে নিউমার্কেট থানায়

পিলখানা হত্যার ঘটনায় ২০০৯ সালের ৪ মার্চ লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবজ্যোতি খীসা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলাটি পরে ৭ এপ্রিল নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়। মামলায় ডিএডি তৌহিদসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয় প্রায় এক হাজার বিডিআর জওয়ানকে।

দুই মামলায় সিআইডির চার্জশিট দাখিল

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়। হত্যা মামলায় ৮২৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। একই সঙ্গে ৮০১ জনকে আসামি করে বিস্ফোরক আইনে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।

বিচারিক আদালতে রায় ঘোষণা

হত্যা মামলায় রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের শুনানি এবং বিচার শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালত রায় দেন। সে সময়কার ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আক্তারুজ্জামান (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি) বহুল আলোচিত এ মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ২৭৮ জনকে বেকসুর খালাস দেন।

হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল আবেদন রায়

রায় ঘোষণার পর নিম্ন আদালত থেকে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হয়। আর কারাবন্দি আসামিরাও আপিল করেন। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও আপিল করা হয়। সব আবেদনের শুনানির পর হাইকোর্ট বিচার শেষে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর রায় দেন।

হাইকোর্টের রায়ে নিম্ন আদালতে ১৫২ জন ফাঁসির আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আটজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও চারজনকে খালাস, নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১২ জনকে খালাস এবং নিম্ন আদালতে খালাসপ্রাপ্ত ৩৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া নিম্ন আদালত ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিলেও হাইকোর্ট ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।