কর্মচারীদের পদোন্নতি দিতে কাল ডাকা হয়েছে সভা

পদোন্নতি নিয়ে মাউশিতে নয়ছয়ের অভিযোগ

প্রকাশিত: ৯:৫৮ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৪, ২০২০

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরে কর্মচারীদের পদোন্নতি নিয়ে নয়ছয় শুরু হয়েছে। বিধি ভেঙে ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে কর্তৃপক্ষ। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে সাধারণ কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। তাদের বক্তব্য, মাত্র কয়েকজনকে পদোন্নতি দিতে সাধারণ কর্মচারীর বড় অংশকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে। কাল সোমবার পদোন্নতি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সাধারণ কর্মচারীদের বক্তব্য হলো- পদোন্নতির জন্য একটি সঠিক ও নির্ভুল জ্যেষ্ঠতার তালিকা (গ্রেডেশন লিস্ট) প্রয়োজন ছিল, যা মাউশির চলমান পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি। মাউশির কর্মচারীরা জ্যেষ্ঠতার তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্য। জ্যেষ্ঠতার তালিকার খসড়া প্রণয়ন করে নোটিশ বোর্ড অথবা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার বিধান রয়েছে। প্রকাশিত তালিকা সম্পর্কে কর্মচারীদের কারও কোনো অভিযোগ থাকলে ৩০ দিন সময় দিয়ে আপিল করারও বিধান আছে। কেউ আপিল করলে সব আপিল গ্রহণ করে একটি কমিটির মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করার নিয়ম রয়েছে। অথচ মাউশির বর্তমান পদোন্নতির ক্ষেত্রে এসব বিধান মানা হয়নি। জ্যেষ্ঠতার খসড়া তালিকা সম্পর্কে যে কর্মচারীরা আপিল করেছেন তাদেরও শুনানির জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ডাকা হয়নি। আপিলে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তাও তাদের জানানো হয়নি।

জানা গেছে, যে সব কর্মচারী আবেদন করেছেন শুধু তাদেরই গ্রেডেশন তালিকা করা হয়েছে, যা বিধিসম্মত নয়। মাউশি যে জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রকাশ করেছে তা গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। এতে দেখা গেছে, মাউশির সকল কর্মচারীর নাম তাতে নেই। পদোন্নতির জন্য চূড়ান্ত করা জ্যেষ্ঠতার তালিকা বিধিসম্মত হয়নি বিধায় কর্মচারীরা নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন।

গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর জারি করা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এসআরও নম্বর ৩০৪ নিয়োগ ও পদোন্নতি বিধিমালার তফসিল-১ এ ‘প্রধান সহকারী’ পদটি পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করার কথা বলা আছে। এ পদে পদোন্নতির জন্য ফিডার পদ উচ্চমান সহকারী পদে অনূ্যন ২ বছর অথবা সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে অনূ্যন ২ বছর চাকরি হতে হবে। উচ্চমান সহকারী ও সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর ছাড়া অন্য কোনো পদ থেকে প্রধান সহকারী পদে পদোন্নতির বিধান নেই। অথচ মাউশি কর্তৃপক্ষ প্রধান সহকারী পদে পদোন্নতির জন্য জ্যেষ্ঠতার তালিকায় মোট ৪টি পদকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। পদগুলো হলো- প্রধান সহকারী (কলেজ), উচ্চমান সহকারী, হিসাবরক্ষক কাম ক্লার্ক এবং সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর, যা বিধিবহির্ভূত।

সরকারি এসআরও অনুসারে, প্রধান সহকারী পদে ফিডার পদ দুটি। উচ্চমান সহকারী ও সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর। জ্যেষ্ঠতার ক্ষেত্রে এই দুই পদের কর্মচারীরাই জ্যেষ্ঠতা তালিকায় স্থান পাবেন এবং এই দুই পদের যোগদানের তারিখ থেকে অর্থাৎ ফিডার পদে যোগদানের তারিখ থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করার বিধান। মাউশি এ বিধানও মানেনি। মাউশির তৈরি করা তালিকায় ২ নম্বর ক্রমিকে থাকা কর্মচারী মো. আলী আকবর ২০০৭ সালের ৭ মার্চ উচ্চমান সহকারী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। অথচ এ তালিকার ৫৯ ক্রমিকে থাকা কর্মচারী জয়ন্তী রানী ধর ১৯৯৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সাঁটলিপিকার পদে যোগদান করেন। উচ্চমান সহকারী পদটি জাতীয় বেতন স্কেলের ১৪ নম্বর গ্রেডের পদ। সাঁটলিপিকার পদটি ১৩ নম্বর গ্রেডের পদ। আলী আকবরের ফিডার পদে কর্মকাল প্রায় ১৩ বছর, অন্যদিকে জয়ন্তী রানী ধরের কর্মকাল ২২ বছর। জয়ন্তী রানী ধর সরকারি বিধান অনুসারে আলী আকবরের থেকে ফিডারের কর্মকাল ও গ্রেড বিবেচনায় ওপরে। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় জয়ন্তী রানী ধরের নাম আলী আকবরের ওপরে থাকার কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে মাউশি তা করেনি। মাউশির পদোন্নতি তালিকায় এরকম অনেক অসঙ্গতি আছে।

একইভাবে ২০১১ সালে জারি করা এসআরওর অনুচ্ছেদ ৭ অনুসারে উচ্চতর বেতন স্কেলের পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে পদোন্নতি কমিটি কর্তৃক পূর্ব তারিখে সুপারিশকৃত ও অনুমোদিত কর্মকর্তা বা কর্মচারী পরবর্তী তারিখে সুপারিশকৃত ও অনুমোদিত কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ওপর জ্যেষ্ঠতা পাবেন। অথচ জ্যেষ্ঠতার তালিকার ক্রমিক ১২ নম্বরে থাকা কর্মচারী সঞ্জয় কুমার বণিক ২০১৪ সালের ৩০ জুন উচ্চমান সহকারী পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তালিকার ক্রমিক ১০৭ নম্বরে কর্মচারী মো. মেহেদী হাসান ৯ বছর আগে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি উচ্চমান সহকারী পদে পদোন্নতি পান। বিধি অনুযায়ী মো. মেহেদী হাসানের নাম কর্মচারী সঞ্জয় কুমার বণিকের ওপরে স্থান পাওয়ার কথা। মাউশির জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এরকম বহু স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, সঞ্জয় কুমার বণিক ২০১৪ সালের ৩০ জুন উচ্চমান সহকারী পদে পদোন্নতি পেলেও ১৮ নম্বর ক্রমিকে থাকা কর্মচারী মো. নুরুল আমিন তার বহু আগে ১৯৮৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রধান সহকারী (কলেজ) হিসেবে নিয়মিতকরণ হন। এখানে উল্লেখ্য, কলেজের প্রধান সহকারীর পদটি উচ্চমান সহকারীর সমমান, বেতন স্কেলের ১৪ নম্বর গ্রেডের। মো. নুরুল আমিন ১৯৮৭ সাল থেকে কর্মরত আর সঞ্জয় কুমার বণিক একই গ্রেডে ২০১৪ সাল থেকে কর্মরত। মো. নুরুল আমিন বর্তমানে ঢাকা কলেজের প্রধান সহকারী পদে কর্মরত। সঞ্জয় কুমার বণিক একই কলেজে হিসাবরক্ষক পদে কর্মরত। হিসাবরক্ষকের পদটি প্রধান সহকারীর অধীন একটি পদ। সরকারের জারি করা এসআরও অনুসারে সঞ্জয় কুমার বণিক কোনোভাবেই মো. নুরুল আমিনের চেয়ে জ্যেষ্ঠ নন। গ্রেডেশন তালিকায় মো. নুরুল আমিনের নামটি সঞ্জয় কুমার বণিকের ওপরে স্থান পাওয়ার কথা থাকলেও মাউশির তালিকায় তা করা হয়নি।

২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর জারি করা সরকারি এসআরও নং-৩৬৯-এর ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ এতদ্‌সংক্রান্ত অন্য কোন বিধি-বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কর্মচারীগণ ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণিতে বিভাজনের বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তে বেতনস্কেলের গ্রেডভিত্তিক পরিচিত হইবেন।’ মাউশির অধীন একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, এই বিধি অনুসারে শ্রেণিপ্রথা বাদ দিয়ে গ্রেডভিত্তিক পরিচিতি পাওয়ায় গ্রেডভিত্তিক জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রণয়ন যুক্তিসঙ্গত। অর্থাৎ নিম্ন গ্রেডের কর্মচারী উচ্চ গ্রেডের কর্মচারীর চেয়ে কখনও জ্যেষ্ঠ হতে পারেন না। তারা জানান, এভাবে গোঁজামিল দিয়ে ভুলে ভরা জ্যেষ্ঠতার তালিকা তৈরি করে ২০১৬ সালেও একবার পদোন্নতি দেওয়ার পাঁয়তারা করেও সফল হয়নি মাউশি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তখন তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন আবারও একই ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়ন করে স্বার্থান্বেষী মহল বিধিবিধান উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি পদোন্নতি দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কর্মচারীরা মাউশিতে কয়েক দফায় আপিল করেও ত্রুটিপূর্ণ এ তালিকার বিষয়ে কোনো প্রতিকার না পেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ স্বাক্ষরিত এক পত্রে এ বিষয়ে মাউশি মহাপরিচালকের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের জানতে চাওয়া এ পত্রের কোনো জবাব না দিয়েই পদোন্নতি প্রক্রিয়া চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এক কর্মচারী জানান, নিয়মবহির্ভূত জ্যেষ্ঠতার তালিকা অনুসারে পদোন্নতি দেওয়া হলে বহু জ্যেষ্ঠ ও যোগ্য কর্মচারী পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হবেন। পদস্বল্পতার কারণে তারা চাকরিজীবনে পদোন্নতিবঞ্চিতই থেকে যেতে পারেন। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা।

এ নিয়ে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক শনিবার বিকেলে গণমাধ্যমকে বলেন, জ্যেষ্ঠতার তালিকা নিয়ে ১০ জন কর্মচারী লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এরপর তাদের অভিযোগগুলো খাতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি তাদের মতামত পদোন্নতির মূল কমিটির কাছে দেবেন। এরপর এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করা হবে।

সূত্র- সমকাল