ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রী: পরিবার একঘরে, পুলিশ দর্শক!

প্রকাশিত: ১১:১২ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ৬, ২০২০

বগুড়ার ধুনট উপজেলায় অপহরণের পর প্রায় দেড় মাস ধরে ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রীর সাত সদস্যের পরিবার গ্রামের মাতব্বরদের সিদ্ধান্তে প্রায় চার মাস ধরে একঘরে হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। স্কুলছাত্রী ধর্ষণ মামলার প্রভাবশালী আসামিদের যোগসাজসে মাতব্বররা হতদরিদ্র পরিবারটিকে একঘরে (সমাজচ্যুত) করে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, এই মাতব্বররা মামলাটি আপস-মীমাংসার নামে বাদীর কাছ থেকে জোরপূর্বক সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে নিয়েছেন। এ ঘটনাটি ঘটেছে বগুড়ার ধুনট উপজেলার গোপালনগর ইউনিয়নের দেউড়িয়া গ্রামে।

ঘটনার পর থেকে অভিযুক্তরা এ বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য মেয়ের পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দেন। কিন্ত এতে কাজ না হলে অভিযুক্তরা গ্রামের মাতব্বর পান্না সরকার, আবু সাইদ ও সোলায়মান আলীর যোগসাজসে ২৮ জুলাই মেয়েটির পরিবারকে সমাজচ্যুত করেন। মামলার পর আসামিদের গ্রেপ্তার কিংবা মেয়েটিকে উদ্ধারে তার পরিবারকে কোনো সহযোগিতা করেনি থানা পুলিশ। এ অবস্থায় ২৫ সেপ্টেম্বর ওই স্কুলছাত্রীকে সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা বাজার এলাকা থেকে উদ্ধার করেছেন তার স্বজনরা। উদ্ধারের পর ওই কিশোরীর ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ মিলেছে।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দেউড়িয়া গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে গোপালনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। ওই ছাত্রীকে একই গ্রামের মজিবর রহমানের ছেলে মাসুদ রানা গোপালনগর ইউনিয়ন পরিষদের চার নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফজলুল হক বাবুর সহযোগীতায় ১৬ জুলাই গ্রামের রাস্তা থেকে অপহরণ করেন। স্কুলছাত্রী ওই সময় বাড়ি থেকে পার্শ্ববর্তী কুনকইনা গ্রামে নানার বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে বের হয়েছিল। এ ঘটনায় মেয়েটির মা বাদী হয়ে ১২ আগস্ট থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় মাসুদ রানা ও ফজলুল হকসহ সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ইউপি সদস্য ফজলুল হকসহ এই মামলার এহাজারভুক্ত ৩ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে।

মামলার বাদী ওই ছাত্রীর মা বলেন, মেয়েকে অপহরণের পর গ্রামের মাতব্বররা বৈঠক করে আমাদের একঘরে করে রেখেছেন। আমাদেরকে গ্রামের কোনো বাড়িতে যেতে দেওয়া হয় না। গ্রামের কোনো মানুষ আমাদের বাড়িতে আসে না। গত কোরবানীর দিন (১ আগস্ট) আমাদেরকে সমাজের মাংস দেওয়া হয়নি। তবে হাটবাজার কিংবা ফসলের মাঠে যেতে কোনো বাধা নেই। এদিকে মামলার পর আসামিদের গ্রেপ্তার ও বাদীকে সহযোগিতা করতে কোনো ভূমিকা রাখেননি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আহসানুল হক। মেয়েকে উদ্ধারের পর থেকে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মামলা তুলে নিয়ে মীমাংসা করতে চাপ দেন। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আমার কাছ থেকে জোর করে সাদা কাগজেও স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। পুলিশের সহযোগিতা না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়েই সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়েছি। এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১ ডিসেম্বর রাতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (এসআই) আহসানুল হককে থানা থেকে বগুড়া পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলার গোপালনগর ইউনিয়নের দেউড়িয়া গ্রামের মাতব্বর পান্না সরকার বলেন, ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রীর পরিবারটিকে একঘরে রাখার কথা শুনেছি। তবে ওই বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম না।

উপজেলার গোপালনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন সরকার বলেন, পরিবারটিকে একঘরে করে রাখার খবর পেয়ে কয়েক দিন আগে ওই গ্রামে গিয়ে পরিবারটিকে আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে বলা হয়েছে।

ধুনট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালা বলেন, অপহরণের পর ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রীর পরিবারটিকে একঘরে করে রাখার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।