![ব্যক্তির অদক্ষতায় রাষ্ট্রের ক্ষতি](https://i0.wp.com/timesbd24.com/wp-content/uploads/2019/01/image-129633-1546630199.jpg?fit=728%2C410&ssl=1)
বিআইডিএস ‘লেবার মার্কেট অ্যান্ড স্কিল গ্যাপ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখানো হয়, হালকা প্রকৌশল খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ৭৫ শতাংশ নির্মাণ খাতে ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং কৃষিতে ৬০ শতাংশ অদক্ষ। এছাড়া জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ৯৫ শতাংশ অদক্ষ ও স্বল্পদক্ষ। এর বাইরে তৈরি পোশাক খাতে ৯২ শতাংশ, আইসিটিতে ৪০ শতাংশের বেশি, চামড়া শিল্পে ৮৬ শতাংশ, পর্যটন খাতে ৭২ শতাংশ প্রবেশ করে অদক্ষ লোক।
স্বাস্থ্য খাতের প্রযুক্তিনির্ভর পদগুলোতে আরও বেহাল। বিভিন্ন খাতে কর্মরতদের অদক্ষতায় চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের তাদের ব্যবসার গুণগত মান ও বিপণন আধিপত্য ধরে রাখার জন্য জনবল আমদানি করতে হচ্ছে। আবার এর উল্টোটিও হচ্ছে।
আবার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বা খাত স্থানীয় দক্ষ কর্মী থাকার পরও তাদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। তবে বাস্তবতা হল- দেশে দক্ষ কর্মীর ঘাটতি রয়েছে। উচ্চশিক্ষা থেকে নানাবিধ শিক্ষার বাণিজ্যিক প্রসার ঘটলেও মেধাবী কর্মী মিলছে না। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন কারখানায় উচ্চপদস্থ মধ্যবর্তী ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখানোর মতো কর্মী খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবে কর্মীর অদক্ষতা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এ প্রসঙ্গে খোদ অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অদক্ষতার কারণে বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে ৪০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দুই লাখ দক্ষ বিদেশি কর্মীর মজুরি হিসেবে বিপুল পরিমাণ টাকা গুনতে হচ্ছে। বিদেশি কর্মীরা এ বিপুল পরিমাণ টাকা প্রতি বছর ব্যাংকিং চ্যানেলে বা অন্য কোনো পথে নিয়ে যাচ্ছেন।
অদক্ষতার সুযোগ নিয়ে দেশীয় অর্থনীতির চালকের আসনে এখন বিদেশিরা। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন শিল্প মালিকরাও। উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা সচল রাখতে তারা প্রকৃত মজুরির চেয়েও দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি মজুরিতে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, ব্যবস্থাপক ও দক্ষ শ্রমিক আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এসব বিদেশি কর্মীর পেছনে উদ্যোক্তাদের প্রতি বছর গড়ে মজুরি দিতে হচ্ছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলারের মূল্যমান ৮০ টাকা ধরলেও এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাবে বর্তমানে চলতি বাজার মূল্যে জিডিপি পরিমাপ করা হচ্ছে ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতি বছর দেশীয় জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ প্রতি বছর বিদেশিরা নিয়ে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পৌঁছাতে হলে সামনের দিনগুলোতে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর নির্ভর করতে হবে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জন জরুরি। এজন্য সরকার এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি ও মানসম্পন্ন ইনপুট ব্যবহার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও আধুনিকায়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
বাস্তবতা হল- বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর দেশে দক্ষতা উন্নয়নে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আবার কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৈদেশিক বিনিয়োগ আসায় বিদেশি প্রযুক্তি ও দক্ষতার সঙ্গেও দেশের সংযোগ ঘটছে না।
আঙ্কটাডের ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০১৮ অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে ২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে প্রতিবেশী ভারতে ৪০ বিলিয়ন, চীনে ১৩৬ বিলিয়ন এবং ভিয়েতনামে ১৪ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষতা উন্নয়ন, কারিগরি ও ভোকেশনাল এবং উন্নত প্রযুক্তির প্রসারের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি জরুরি।
জানা গেছে, জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে সরকার একটি শিক্ষানীতি হাতে নেয়। এ নীতি খুবই প্রগতিশীল এবং সময়োপযোগী। যেখানে শ্রমসংশ্লিষ্ট কাজের কথা বলা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা ও নৈতিকতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এখানে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কারিগরি শিক্ষার কথাও বলা হয়েছে। যেখানে অষ্টম শ্রেণীর পর যদি কেউ আর লেখাপড়া না করে সে যেন দক্ষতা অনুযায়ী একটি কর্ম বেছে নিতে পারে সে লক্ষ্যে নির্দেশনা রয়েছে।
আর যদি লেখাপড়া করে তাহলে কারিগরি শিক্ষা নিতে হবে। এরপর ২০১১ সালে দক্ষতা উন্নয়ন নীতি নামে আরেকটা নীতি প্রণয়ন করা হয়। এর জন্য একটা কাউন্সিলও গঠিত হয়েছে। কিন্তু এত বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো আইন বা প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। নীতিগুলো কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত শিক্ষা আইন হয়নি।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের শিল্প খাতের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমের মধ্যে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এটি দূরীকরণে শিল্প-শিক্ষায়তন সম্পর্ক আরও গভীর করা প্রয়োজন। কারণ দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার সবচেয়ে বেশি।
আবার ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অনুযায়ী মানবসম্পদ পাচ্ছে না। তাই শিল্প-কলকারখানার চাহিদামাফিক দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ সরবরাহের উদ্দেশ্যে এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সিলেবাস প্রণয়ন করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতিতেও সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি আরও বেশি বাস্তবানুগ ও আধুনিকীকরণ করে শিল্পের দক্ষতা চাহিদা মেটাতে এগিয়ে আসতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, প্রবৃদ্ধিকরণ, জনগণের ক্ষমতায়ন এ স্লোগান নিয়ে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে আর্থ-সামাজিক সূচকের চেয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নেই বেশি জোর দেয়া হয়েছে।
এজন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতে বিনিয়োগ, কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে। যেখানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদাকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
‘গ্লোবাল হেলথ ওয়ার্কফোর্স লেবার মার্কেট প্রজেকশন ফর-২০৩০’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে আট কোটি দক্ষ ও স্বল্পদক্ষ নার্স, মেডিকেল পেশাজীবীসহ স্বাস্থ্যসেবীর চাহিদা তৈরি হবে। কিন্তু চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ছয় কোটি ৫০ লাখ দক্ষ কর্মী তৈরি হবে। দেড় কোটি স্বাস্থ্যসেবীর ঘাটতি দেখা দেবে।
তথ্যানুযায়ী উচ্চমধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এ চাহিদা তৈরি হবে। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবার ক্রমবর্ধমান এ চাহিদা মেটাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ। বর্তমান বিশ্বের শ্রমবাজার হল মেধাভিত্তিক বাজার। কিন্তু আমাদের প্রবাসীদের বেশির ভাগই শ্রমভিত্তিক পেশায় জড়িত। বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) খাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপানে এ মুহূর্তে ২০ লাখ প্রোগ্রামার প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করা গেলে বিপিও খাতে তাদের ব্যাপক কর্মসংস্থান হতে পারে। বৈদেশিক আয়ের বড় অংশ প্রবাসী আয়। বৈদেশিক বিনিয়োগের চেয়ে প্রবাসী আয় বহুগুণ বেশি।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দশ লাখ বাংলাদেশির। কিন্তু এই প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগই অদক্ষ এবং স্বল্পদক্ষ। তাদের পরিপূর্ণভাবে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে বিদেশে পাঠানো গেলে প্রবাসী আয় বর্তমানের তুলনায় তিনগুণ বাড়ত।