বন্ধ হয়েছে ৬১ কারখানা, শ্রমিকরা হারিয়েছেন চাকরি

দুর্দিন যাচ্ছে পোশাক শিল্পের

প্রকাশিত: ৪:৩৪ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তাণিপণ্য বর্তমানে একটি দুর্দিন পার করছে। একদিকে কারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিকরা চাকরি হারাচ্ছেন আর অন্যদিকে রপ্তানি কমে যাচ্ছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, জুলাই এবং নভেম্বর মাসের মধ্যে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ রপ্তানি কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) তৈরি পোশাক রপ্তানি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম।

বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, এই বছরের নভেম্বর পর্যন্ত গত ১১ মাসে কারখানা বন্ধ হয়েছে ৬১টি এবং চাকরি হারিয়েছেন ৩১,৬০০ জন শ্রমিক।

তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম এই বছরের প্রথম ১০ মাসে পোশাক রপ্তানি করেছে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে এভাবে রপ্তানি পড়ে যাওয়া, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্রমিকদের চাকরি হারানোর পেছনে পোশাক রপ্তানিকারক এবং বিশ্লেষকরা পাঁচটি কারণের কথা বলেছেন।

প্রথমত, মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার শক্ত অবস্থান ধরে রাখা। দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের দেশের পোশাক রপ্তানিকারকদেরকে বিভিন্ন ধরনের নীতি সহায়তা প্রদান করছে যার ফলে সেসব দেশের রপ্তানিকারকরা কম দামে পোশাক রপ্তানি করতে পারছে।

তারা আরও বলছেন, বিভিন্ন কারণে যেমন গত বছরের ডিসেম্বরে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কারণে কারখানায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। তারা আরও বলেন, উৎপাদনে দক্ষতার অভাব এবং ব্যবসায় অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ার কারণে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশ এখনও গুটিকয়েক আইটেম এবং অল্প সংখ্যক বাজারে পোশাক রপ্তানি করছে। বাংলাদেশের পোশাক এবং বাজারের বৈচিত্র্য কম। রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে এগুলো অন্যতম বাধা।

বিজিএমইএ এর সভাপতি রুবানা হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমাদের রপ্তানির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি বলছে সামনের দিনগুলোতেও সুখবর নেই।”

ডিসেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি ৩ শতাংশ কমেছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, পুরো ডিসেম্বর জুড়ে রপ্তানি পড়তির দিকে থাকবে।

রুবানা হক আরও বলেন, রপ্তানির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নিয়ে ধারণা দেওয়াটা আসলে কঠিন। কারণ, বৈশ্বিক বাজার খুবই অস্থির। তিনি বলেন, সম্প্রতি বৈশ্বিক বাজার অস্থির হয়েছে বেশ কয়েকটি কারণে। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভিয়েতনামের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সই এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনা পণ্যের মূল্য হ্রাস। এছাড়াও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে উঠে আসছে নতুন নতুন দেশ।

“উদীয়মান অনলাইন কেনা-বেচা প্রচলিত ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসবে। এর মধ্যে যদি আমরা নিজেদের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারি তাহলে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে টিকতে পারব না,” বলেন রুবানা হক।

এসবের সম্ভাব্য ফলাফল হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে আরও কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, আরও বেশি শ্রমিক চাকরি হারাবে এবং শেষমেশ রপ্তানি আরও কমবে। যার প্রভাব পড়বে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে।

তিনি আরও বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে সংকট উত্তরণের জন্য সরকারের কাছে কিছু নীতি সহায়তার আবেদন করেছি। সরকার আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়েছে এবং উৎস কর শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। যাই হোক, আমরা উৎস কর কমানোর সিদ্ধান্ত গত বছর থেকে কার্যকর করার অনুরোধ জানিয়েছি।

সেই সঙ্গে ১ শতাংশ বিশেষ প্রণোদনা পাওয়ার শর্তগুলো তুলে দিতে এবং প্রণোদনার ওপর ধার্যকৃত কর প্রত্যাহারের জন্যও বিজিএমইএ এর তরফ থেকে সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানান রুবানা হক।

তিনি বলেন, যেহেতু মুদ্রার বিনিময় হার দেশের রপ্তানির প্রতিযোগিতার সক্ষমতার ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা, তাই বিজিএমইএ আশা করে পোশাক রপ্তানিকারকদেরকে সরকার রপ্তানি আয়ের প্রতিটি ডলারের বিনিময় হারে অতিরিক্ত পাঁচ টাকা করে দেবে। এমনকি সরকার এক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ রপ্তানি আয়ের ওপর পাঁচ টাকা করে অতিরিক্ত দিতে পারে।

রুবানা হকের মতে, পোশাক শিল্পে পণ্য এবং বাজার বহুমুখীকরণের বিষয়গুলো অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ। তাই এক্ষেত্রে নতুন পণ্য তৈরি এবং উদ্ভাবনে বিশেষ প্রণোদনা দরকার।

“ব্যবসাকে টেকসই করার জন্য আমাদের একটি এক্সিট পলিসিও দরকার,” যোগ করেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকার সাময়িকভাবে টাকাকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে দুর্বল করতে পারে। এক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট রপ্তানিযোগ্য পোশাক এই সুবিধা পেতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ম্যান মেড ফাইবার থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের আরএমজি পণ্যের বহুমুখীকরণ ঘটবে।

তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে ১ ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ৯০ টাকা করা যেতে পারে। তবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। বরং তিনি পোশাক শিল্পে আরও ৩০ শতাংশ দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রাক্তন অর্থনীতিবিদ মনসুর আরও বলেন, “পোশাক খাতে দক্ষ ব্যবস্থাপনার চর্চা, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং বাজার ও পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দক্ষতা আনয়ন করা যেতে পারে।”

সূত্র: দ্যা ডেইলি স্টার