প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপনের প্রস্তুতি

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ধারণাপত্র: বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ ১৫ চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ৩:২৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৮, ২০১৯

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কী ধরনের ভিত্তির ওপর তৈরি হবে সে বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন ইতিমধ্যে একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছে। এতে বেসরকারি বিনিয়োগে গতি বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ ১৫টি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশেষ প্রস্তুতি নেয়া হবে।

 

২০২১ থেকে ২০২৫ সালের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও পরিকল্পনা-২০৪১-কে দিকনির্দেশক হিসেবে ধরা হচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করাই হল মূল লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধারণাপত্রটি শিগগিরই উপস্থাপন করা হতে পারে বলে জানা গেছে।

ধারণাপত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সেগুলোর অন্যতম হল- জিডিপি প্রবৃদ্ধির কাঠামোগত রূপান্তরকরণ। এছাড়া রয়েছে আর্থিক খাতে সংস্কার, অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ চিহ্নিতকরণ এবং রফতানি বৈচিত্র্যকরণ। আরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হল- ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে গতি আনা, কর্মদক্ষতার সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা, চরম দারিদ্র্য নির্মূল, আয় ও আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস, মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন ও বিকেন্দ্রীকরণ এবং একটি পরিবর্তনশীল জনতাত্ত্বিক চিত্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা।

পরিকল্পনাটি তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১০ বছরে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য নিরসন এবং মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত সূচক অতিক্রম করে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছে বাংলাদেশ। আগামী কয়েক বছরে জাতিসংঘ নির্ধারিত স্বপ্লোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে আসবে। দারিদ্র্য হ্রাস এবং দ্রুত টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে উন্নয়নের এ ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হচ্ছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। তাই এটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ২০২০ সালের মে মাসে পরিকল্পনাটি যাতে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় অনুমোদন করা সম্ভব হয় সে লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পা প্রণয়নের কাজ চলছে।

ধারণাপত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- বেসরকারি বিনিয়োগের মন্দাভাব প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেসরকারি বিনিয়োগকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি বিনিয়োগের হার জিডিপির ২২ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রচেষ্টা রয়েছে।

তবে বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২৩ শতাংশ। এ মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারি বিনিয়োগ হার বৃদ্ধি করা হলেও সামগ্রিক বিনিয়োগ প্রচেষ্টা ৯ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেসরকারি এবং মোট বিনিয়োগ হার বাড়ানোর জন্য অধিক প্রচেষ্টা চালানো হবে। একই সঙ্গে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হবে- যা নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রফতানি বাজার সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে বলা হয়- পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ-২০১৭ অনুসারে দ্রুত প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি সন্তোষজনক ছিল না। বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশের বিপরীতে ২০১০ এবং ২০১৭ সালের মধ্যে কর্মসংস্থান ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ। কিন্তু ইতিবাচক দিক হল- কৃষিতে কর্মসংস্থান ৪৮ থেকে কমে ৪১ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে কর্মসংস্থান ১২ থেকে বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে।

এরপরও নারী শ্রমশক্তির উচ্চতর অংশগ্রহণ, জনসংখ্যাগত রূপান্তর থেকে ওঠে আসা ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তির প্রয়োজনের তুলনায় ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার খুবই কম। এছাড়া কৃষি ও অনানুষ্ঠানিক সেবা খাতেও কর্মসংস্থান কম। নির্মাণ কাজ এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে প্রযুক্তি প্রবর্তনের ফলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে দক্ষতার অভাব একটি গুরুতর সমস্যা। প্রযুক্তির পরিবর্তন এবং দক্ষতার সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জগুলো অন্তর্ভুক্ত করে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সেগুলো সমাধানে গুরুত্ব দেয়া হবে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং কাঠামোগত রূপান্তর বিষয়ে ধারণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের বাজার অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হল উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলো সবার মাঝে সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে অভ্যন্তরীণভাবে যুক্ত। ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের উৎপাদন কাঠামোর ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিক উৎপাদনশীল এবং সংগঠিত সেবামূলক অর্থনীতিতে রূপান্তর করা হয়।

এ ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু দেশে দুই অঙ্কের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ১৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন এবং কাক্সিক্ষত কাঠামোগত রূপান্তর অর্জনের জন্য আধুনিক পরিষেবার মান আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া উৎপাদন রূপান্তর খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টি সন্তোষজনক নয়। এর কারণ চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রগতির ধারা স্থিতিশীল রাখতে আরও নতুন কৌশল সৃষ্টি করা যেতে পারে। কাঠামোগত পরিবর্তন এবং অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কিছু সীমাবদ্ধতা এবং চ্যালেঞ্জ শনাক্ত করে সমাধানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।