মিথ্যা তথ্যে মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়ন, বাতিল হচ্ছে ১০২ সনদ

প্রকাশিত: ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৩, ২০১৯
শিগগিরই গেজেট বাতিলের প্রজ্ঞাপন * প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন সংস্থা প্রধান, আয়কর কর্মকর্তা, কৃষি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও চিকিৎসক, ব্যাংকার, পেশকার * অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা -সচিব

ভুল ব্যাখ্যা ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ (প্রত্যয়নপত্র) নেয়ায় ১০২ মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও এ সংক্রান্ত গেজেট বাতিল করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৫৯ জনই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। বাকি ৪৩ জন বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত।

শিগগিরই সনদ ও গেজেট বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করবে মন্ত্রণালয়। এই সনদ ব্যবহার করে সংশ্লিষ্টরা যেসব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন সেগুলো বাতিল হবে কিনা তা গেজেট জারির পর সিদ্ধান্ত হবে। তবে এর মধ্যে যারা আদালতের আশ্রয় নিয়েছে তাদের বিষয়ে রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

সরকারি চাকরিতে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বিক বিষয়ে খোঁজ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গোয়েন্দা সংস্থাকে দেয়া হয়। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে মাঠে নামেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি জীবনের ব্যক্তিগত নথি পর্যালোচনা, এলাকায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ, স্থানীয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনার পর ৫৯ জনের তালিকা তৈরি হয়।

এছাড়া বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে নানা সময়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তাদের ব্যক্তিগতভাবে শুনানি গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়ায় যায়নি। এরপর এই ৪৩ জনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সভায় তোলা হয়। সেখানেই তাদের সনদ ও গেজেট বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এসএম আরিফ-উর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জানি। জামুকার সুপারিশের ভিত্তিতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ এর মধ্যে যারা সরকারের আর্থিকসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়েছেন তাদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত- এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, সনদ ও গেজেট বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারির পর সিদ্ধান্ত হবে। এসব বিষয় নিয়ে আরও কাজ রয়েছে।

এদের মধ্যে কারা আর্থিক সুবিধা, কারা চাকরির সুবিধা নিয়েছেন তা নির্দিষ্ট করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলাও করা হতে পারে। সবকিছুই নির্ভর করবে অভিযুক্তদের অপরাধের মাত্রার ওপর। চাকরির মেয়াদ বাড়াতে বা অন্যান্য সুযোগ নিতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্তত ছয় সচিব। ২০১৪ সালে তাদের সনদ বাতিল করা হলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এবার কি ব্যবস্থা নেবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব আরিফ-উর রহমান বলেন, ‘তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। বর্তমান সময়ের বিষয়ে আমি বলতে পারি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

জানা গেছে, জামুকার ৬১তম সভায় সরকারি ৫৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১০২ মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সরকারের আমলে এটি জামুকার প্রথম বৈঠক। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে এ সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কমিটি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া যেসব উপজেলা থেকে নতুন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১০ শতাংশের কম নাম এসেছে, তা আর যাচাই না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে যে ৫৯ জন আছেন তাদের মধ্যে সংস্থাপ্রধান, কর পরিদর্শক, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সহকারী, পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যাংকার, শুল্ক কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও শিক্ষকের নাম আছে।

আছেন পেশকার, অফিস সহকারী, কেরানি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তাদের অনেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এখনও চাকরি করছেন। কেউ চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে এ সুবিধা নিয়ে ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন। কেউ কেউ এখনও ভাতা পাচ্ছেন। সনদ বাতিলের পর বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নেয়ার জন্য এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে। সনদ দেখাতে পারলেই এক বছর বেশি চাকরি করা যায়। এই সুযোগ কাজে লাগাতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহের হিড়িক পড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে। আর এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর পর। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলে এক বছর বেশি চাকরির সুযোগ ছাড়াও নিজের সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধাও রয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা মাসিক সম্মানীও পেয়ে থাকেন।

বাতিল হচ্ছে যাদের সনদ : বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক সহিদুর রহমান, আয়কর কর্মকর্তা আ জা মু জিয়াউল হক, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আ. ওহাব সরদার, ঢাকা ট্রাক ডিপোর ডেপুটি ম্যানেজার মো. আবদুস সালাম, বাংলাদেশ বেতারের কর্মকর্তা এবিএম তমিজ উদ্দিন, ব্যাংকার এটিএম কামরুজ্জামান, ডা. একেএম আশরাফ উজ্জামান, বিএডিসি কর্মকর্তা আবদুল মালেক, চট্টগ্রাম আদালতের পেশকার সমর কান্তি বড়–য়া, দিনাজপুরের আবু তাহের শাহ, মো. শাহাবুদ্দিন শাহ, মুন্সীগঞ্জের মোল্লা সাহাব উদ্দিন (লাল মুক্তিবার্তা নং-০১০৩০১০৩০৩) ও আবদুল হালিম, সিরাজগঞ্জের আব্বাস আলী খান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের দেলদার হোসেন, টাঙ্গাইলের চক্রবর্তী প্রভাত কুমার, কাজী গোলাম সারওয়ার, মাদারীপুরের বাহাউদ্দিন হাওলাদার, ফকির আবদুল মান্নান মিয়া ও বজলুর রহমান, চাঁদপুরের আবুল হোসেন খান, মিজানুর রহমান ও আবদুল মান্নান চৌধুরী, খুলনার এমএ বাশার, গোপালগঞ্জের এমডি বাদশা মিয়া, ময়মনসিংহের আতিকুল ইসলাম ও আবদুল হাকিম, চট্টগ্রামের প্রিয়নাথ বড়–য়া, পঞ্চানন চৌধুরী, পটুয়াখালীর বিমল চন্দ্র শীল ও চিত্তরঞ্জন মণ্ডল, ঢাকার আবদুস সামাদ, কক্সবাজারের আমজাদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জের এসএম কামাল হোসেন, ফরিদপুরের আবজাল হোসেন ও একেএম আসাদুজ্জামান, গাজীপুরে মো. মাজহারুল হক, ঝালকাঠির সুলতান আহমেদ মৃধা, বরিশালের আবদুল বারী, ইউএসএম মো. এমএ ছাত্তার হাওলাদার ও রফিকুল ইসলাম খান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুল গফুর, ভোলার নজরুল ইসলাম, আবদুল গনি ও মো. মজনু, কুষ্টিয়ার মাহবুবুল করিম ও মছলেম উদ্দিন, নড়াইলের আবুল বাশার মোল্যা, কুমিল্লার গোলাম মওলা, ঝিনাইদহের জাফর জমাদার, গাইবান্ধার গণেশ চন্দ্র সাহা ও সামছুল হক মিয়া, হবিগঞ্জের আবদুল মান্নান, পাবনার শহিদুর রহমান, বগুড়ার মোস্তাফিজুর রহমান, সিলেটের মুহিবুর রহমান এবং বরগুনার মাহতাব উদ্দিন।

৫৯ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাবেক মহাপরিচালক সহিদুর রহমান ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে’ বাড়তি চাকরির মেয়াদ শেষ করে অবসরে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তার ছেলে আশিকুর রহমান বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডে সহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরি করছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সহিদুর রহমান মঙ্গলবার মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমি কোনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নই। জামুকার ৪৮তম সভায় আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশ করেছে। এবার যেটা বলা হচ্ছে তা ভুল তথ্যের মাধ্যমে করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমি যোগাযোগ করেছি, তারা বলেছে এটি ঠিক করে দেবেন।’ সনদ বাতিল হলে আপনার চাকরি সুবিধা ও আর্থিক বেনিফিট ও সন্তানের চাকরির কি হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সহিদুর বলেন, ‘প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেব। হেরে গেলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা হবে।’

এছাড়া সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া যাদের সনদ ও গেজেট বাতিল হতে যাচ্ছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার গাউছুর রহমান। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তার দুই সন্তান ৩১তম বিসিএসে নিয়োগ পেয়েছেন।

এদের একজন বিলুপ্ত ইকনোমিক ক্যাডারের মো. আজিজুল হক ও পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম। বরিশালের মুলাদী উপজেলার মফসের সরদার, কুষ্টিয়ার মৃত মোজাফফর শেখ, খুলনার ডুমুরিয়ার স.ম. আবু বক্কর সিদ্দিকী, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সাহাব উদ্দিন, টাঙ্গাইল সখীপুরের মো. আবুল হোসেন, ঘাটাইলের মৃত ওয়াহেদ খান, নরসিংদীর রায়পুরার নুরুল ইসলাম, নাজমুল হাসান, আবু ছাইদ, আবু সাদেক, মোশারফ হোসেন, হাবিবুর রহমান, শাহজাহান, মো. কেনুর রহমান, ওয়াহিদুল হক, ওয়াজ উদ্দিন, আদম আলী, আ. বাছেদ, আবদুস সামাদ, হোসেন আলী, ফজলু মিয়া, আবদুল বাছেদ, আসাদুজ্জামান, তোফাজ্জল হোসেন, জসিম উদ্দিন, মোসলেম উদ্দিন মিয়া, নরসিংদী সদরের এমএ বাশার বাচ্চু, দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর রিয়াজ উদ্দিন ও গোলাম মোস্তফা, কুমিল্লা হোমনার আবদুল আজিজ খন্দকার, মো. মোবারক হোসেন, ছিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী, ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার শাহজাহান মাস্টার, সোনাগাজী উপজেলার আবুল কাশেম, চাঁদপুর সদরের আবদুল্লাহিল বাকী, আবদুর রশিদ খান, আমিনুল হক মুন্সী, হাবিলদার সুলতান (অব.), আবদুল মান্নান, মোখলেসুর রহমান এবং কুমিল্লার হোমনার মিজানুর রহমান (লাল মুক্তিবার্তা নং-০২০৪১২০১৪৭)।