এনবিআরে শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদন

জুয়ার সামগ্রী আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার

প্রকাশিত: ৬:২২ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৩, ২০১৯

ক্যাসিনো বা জুয়ার উপকরণ আমদানির আড়ালে দেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ পাচার করা হয়েছে। আমদানি করা পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে অনেক বেশি দেখিয়ে এবং ঘোষণার চেয়ে কম পণ্য আমদানি করে অর্থ পাচার হয়েছে।

 

শুধু অর্থ পাচার নয়, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে রাজস্বও ফাঁকি দেয়া হয়েছে। প্রকৃতমূল্যের চেয়ে দাম কম দেখিয়ে এবং ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতির বদলে শিল্পের কাঁচামালের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি সোমবার শুল্ক গোয়েন্দা থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে দেয়া হয়েছে। তারা ক্যাসিনোর উপকরণ আমদানির বিষয়ে বিশদ তদন্ত করছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪ বছরে ২০টি প্রতিষ্ঠান ক্যাসিনোর উপকরণ আমদানি করেছে। আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্ট মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে উপকরণগুলো আমদানি করে। এর মধ্যে ১৬টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন খেলাধুলার সামগ্রীর ঘোষণা দিয়ে আমদানি করেছে ক্যাসিনোর উপকরণ।

 

তিনটি প্রতিষ্ঠান সরাসরি ক্যাসিনোর উপকরণ ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি করেছে। এগুলো হচ্ছে- পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ, নিনাদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এবং এএম ইসলাম অ্যান্ড সন্স। একটি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোনের কাঁচামাল হিসেবে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ক্যাসিনোর সামগ্রী আমদানি করেছে।

সোমবার শুল্ক গোয়েন্দার অভিযানে মোবাইল ফোনের কাঁচামাল হিসেবে ক্যাসিনোর উপকরণ আমদানির ঘটনা ধরা পড়েছে। তারা নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে বেস্ট টাইকন বিডি এন্টারপ্রাইজের কারখানা থেকে অনেক উপকরণ জব্দ করেছে। যেগুলো মোবাইল ফোন তৈরিতে ব্যবহৃত হয় না। এগুলো মূলত ক্যাসিনোর উপকরণ।

বাণিজ্যিকভাবে খেলার সামগ্রী আমদানিতে শুল্কসহ বিভিন্ন কর পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন তৈরির কাঁচামাল আমদানি করলে কোনো শুল্ক ও কর দিতে হয় না। এ কারণে মোবাইল ফোন তৈরির কাঁচামাল ঘোষণা দিয়ে এসব পণ্য আমদানি হয়েছে।

একই সঙ্গে মোবাইল ফোন তৈরির কাঁচামালের দাম বেশি, ক্যাসিনোর উপকরণের দাম অনেক কম। এর মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়েছে। এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত করছে।

সূত্র জানায়, ক্যাসিনোর উপকরণ আমদানির নামে কী পরিমাণ টাকা পাচার করা হয়েছে এবং কী পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়েও বিশদ তদন্ত করছে শুল্ক গোয়েন্দারা।

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাইমস বিডিকে বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জুয়া খেলার সামগ্রী আমদানিতে ব্যাপক শুল্ক ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া যেসব আমদানিকারক ক্যাসিনোসামগ্রী আমদানি করেছে, তারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করেছে বলে তদন্তে জানা গেছে। এসব সামগ্রীর ক্রেতা কারা এবং এগুলোর ব্যবহার কীভাবে হয়েছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। যত দ্রত সম্ভব চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে এ কর্মকর্তা জানান।

শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতিমধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে আরও বিশদ তদন্ত চলছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ, এথ্রি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও বেস্ট টাইকন বিডি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড।

প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলাধুলার উপকরণ হিসেবে ভিডিও গেম, টেবিল গেম, গেম টেবিল, কয়েন অপারেটর গেম, ইলেকট্রিক মাজং মেশিন, গেম মেশিন, স্পোর্টস টেবিল ইত্যাদি পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে ক্যাসিনোয়।

ক্যাসিনোর উপকরণের ঘোষণা দিয়ে ক্যাসিনো ওয়্যার গেম টেবিল, পোকার গেম চিপস, রোলেক গেম টেবিল, ক্যাসিনো কয়েন, ক্যাসিনো চিপস, ক্যাসিনো অপারেটেড গেম ইত্যাদি পণ্য আমদানি হয়েছে। মোবাইল ফোন তৈরির ঘোষণা দিয়েও কিছু ক্যাসিনোর উপকরণ আমদানি করা হয়েছে।

এ ছাড়াও গেমস ও গেমসের বিভিন্ন ধরনের উপকরণের ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ২৯টি পণ্যের চালান সন্দেহবশত আটক করা হয়েছে। সেগুলোর এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই আমদানিকারক ও এক সিএন্ডএফ এজেন্টকে জিজ্ঞাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ সরাসরি ক্যাসিনোর উপকরণ ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে সে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সুর রঞ্জন শেঠ তাপস জানান, তিনি ওইসব যন্ত্রপাতি কমলাপুরের সোহেলের অনুরোধে আমদানি করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিকতর তদন্তে দেখা যায়, মো. ইলিয়াস ওরফে সোহেল পণ্য আমদানি করা পণ্যগুলো গুলশান-১ এর বাসিন্দা দিনেশ ও রাজকুমারের কাছে বিক্রি করেন। এ বিষয়ে আরও তদন্ত হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ৩ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি ভারত থেকে জন্মদিন পালনের উপকরণের সঙ্গে রোলেট গেম ও পোকার মেশিন আমদানি করে অনলাইনে বিক্রি করেন। ক্রেতাদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদেরকে শুনানির জন্য তলব করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বেস্ট টাইকন বিডি এন্টারপ্রাইজের কারখানার ওয়্যারহাউস থেকে মাহাজং নামের ক্যাসিনো বোর্ড ও অন্যান্য সামগ্রী আটক করা হয়েছে। মোবাইল ফোন কারখানার কাঁচামাল হিসেবে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এসব পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মোটা অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। হংকং, ম্যাকাওসহ বিভিন্ন দেশে ক্যাসিনোর টেবিলে মাহাজং ব্যবহৃত হয়।

এছাড়া সোমবার মুন্সীগঞ্জের অ্যাগ্রোটেক লিমিটেডের কারখানায় অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর তিনটি ইলেকট্রিক মাহাজং মেশিন উদ্ধার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা।

যেসব প্রতিষ্ঠান জুয়াসামগ্রী আমদানি করেছে: ৪ বছরে আরও যেসব প্রতিষ্ঠান জুয়া খেলার সামগ্রী বাংলাদেশে আমদানি করেছে এগুলো হচ্ছে- পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ, এথ্রি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এভারগ্রিন প্রোডাক্ট ফ্যাক্টরি, নিউ হোপ অ্যাগ্রোটেক বাংলাদেশ, নিনাদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জিহান ইন্টেরিয়র কম্পোনেন্ট, এএম ইসলাম অ্যান্ড সন্স, মেসার্স চৌধুরী ট্রেডার্স, মুন ট্রেডিং কর্পোরেশন, অ্যালাইড রক ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স বিবি ইন্টারন্যাশনাল, রেডিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল, আলিফ এন্টারপ্রাইজ, সোলজার গিয়ার, চায়না হোটেল সাপ্লাই, জান্নাত ট্রেডিং, বেস্ট টাইকুন বিডি এন্টারপ্রাইজ, সিক্স সি কর্পোরেশন, মেসার্স এমআর ইন্টারন্যাশনাল ও ডংজিং লংজারভিটি ইন্ডাস্ট্রি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান ক্যাসিনো টেবিল ও কয়েন, পোকার চিপস, রুলেট গেম টেবিল, কয়েন অপারেটেড মেশিন, মাহাজং টেবিল ঘোষণা দিয়ে আমদানি করেছে। আমদানি চালান খালাসে জড়িত একাধিক সিএন্ডএফ এজেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।