নির্বাচন ঘিরে ষড়যন্ত্র!

প্রকাশিত: ৩:১৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৮

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। মোবাইল ফোনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার নির্দেশনা দিয়ে লোকজনকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভয়ঙ্কর ফোনালাপে জোট ও ঐক্যফ্রন্টের নীতিনির্ধারকসহ শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটারও পরিকল্পনা আঁটা হচ্ছে। দেশ-বিদেশে বসে বিএনপি নেতাদের এসব পরিকল্পনার ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনকে হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামও এখন আলোচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় একাধিক ফোনালাপ এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। এর আগেও একাধিক ঘটনায় উসকানি দেয়ার ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে।
পুলিশ ও র‌্যাবের ডিআইজি পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন ঘিরে একাধিক চক্র নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। দেশি-বিদেশি তৎপরতাও থাকে। তবে এবারের পরিস্থিতি অন্যবারের চেয়ে ভিন্ন। তাই সবদিক বিবেচনায় রেখে নিরাপত্তা পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সন্দেহভাজনদের গতিবিধির পাশাপাশি তাদের কর্মকাণ্ড ও তৎপরতায় চোখ রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা দেশে এনে ছড়ানোর পর নাশকতা হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে ফাঁস হওয়া একাধিক ফোনালাপের সূত্র ধরেও কাজ করছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার ফোনালাপে ভোটের আগে ও পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করার ইঙ্গিত মিলছে। তাদের কর্মকাণ্ড নজরদারি চলছে। অনেকেই ঘনঘন সিমকার্ড ও ফোন সেট বদল করছেন। ট্রাকিংয়ে নাশকতার পরিকল্পনা ও উসকানির ক্লু মিলেছে। তবে যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান তিনি।
ফোনালাপ থেকে জানা গেছে, ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুকে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে শওকত নামে তার পূর্ব পরিচিত এক ব্যক্তি ফোন করে জানান, ড. কামাল হোসেনকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার পরিকল্পনা করা হয়েছে। লন্ডনে বসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই পরিকল্পনা করে দুবাই থেকে ৭ জন কিলারকে দেশে পাঠিয়েছেন। তারা লাস্ট মোমেন্টে চেষ্টা করবে। ওই ৭ জন পাকিস্তানি নাগরিক উল্লেখ করে শওকত বলেছেন, আপনি ড. কামালকে যেকোনোভাবে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে যান। কারণ ওনার ওপর অ্যাটেম্পট আসবে। বিএনপির লাস্ট স্টেপ হলো ড. কামাল হোসেনকে হত্যা করা। ড. কামাল হোসেন বিএনপির কেউ নন। তাকে হত্যা করে তারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটবে। শওকত আরো বলেন, মন্টু ভাই যেহেতু আমরা একসাথের। আমি এটা লন্ডন থেকে খবর পেয়েছি। তারেক রহমানের খুব ক্লোজ। আপনি জানেন লন্ডনে বিএনপির নেতাকর্মী বেশিরভাগ হচ্ছে আমাদের সিলেটের। যার কাছ থেকে তথ্য পেয়েছেন তাকে ইঙ্গিত করে শওকত বলেন, সে তারেক রহমানের খুব কাছের। ইলেকশনের আগের দিন হলেও ড. কামাল হোসেনকে হত্যা করা হবে বলে মন্টুকে জানান শওকত। গত মঙ্গলবার বিকেলে এই ফোনকল পাওয়ার ১০ মিনিট পর মন্টু ছুটে যান ড. কামালের বাসায়। বুধবার পুলিশ কর্মকর্তারা কামালের সঙ্গে দেখা করে তার নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেন।
একইদিনে ফাঁস হয়েছে রাজশাহী ৫ আসনে বিএনপি প্রার্থী নাদিম মোস্তফার ফোনালাপ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়া দুটি আলাদা অডিওতে রেজাউল করিম নামে বিএনপির এক কর্মী পুলিশকে ঘুষ দিতে বলেন নাদিম মোস্তফা এবং অপরটিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার নির্দেশ দেন ওই কর্মীকে। প্রথম ফোনালাপের অডিওতে নাদিম মোস্তফা তার এ কর্মীকে পুলিশের কোনো ওসি এবং এসআইকে কত টাকা দিতে হবে তা বুঝিয়ে দেন। দ্বিতীয় ফোনালাপে নাদিম মোস্তফা আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর হামলার নির্দেশ দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে এক আইএস কর্মকর্তার ফাঁস হওয়া ৭ মিনিটের ফোনালাপে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। মেহমুদ নামের ওই ব্যক্তি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) কর্মকর্তা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে সাহায্য করার জন্য আইএসআই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে ফোনালাপে দাবি করেন মেহমুদ নামের ওই ব্যক্তি। ফাঁসকৃত ফোনালাপে নির্বাচনে বিএনপিকে জয়ী করতে আইএসআইর কাছে খন্দকার মোশাররফকে সাহায্য চাইতে শোনা যায়। এজন্য একপর্যায়ে তিনি চীনকে ম্যানেজ করার জন্য মেহমুদের কাছে সাহায্য চান। মেহমুদ তার জবাবে জানান, চীনের সঙ্গে বিএনপিকে সাহায্যের ব্যাপারে তাদের (আইএসআই) যোগাযোগ চলছে। বিএনপির এ নেতাকে আইএসআইর বিশ্বস্ত বন্ধু বলে আখ্যায়িত করেন মেহমুদ। খন্দকার মোশাররফও তাদের বন্ধু হয়েই থাকতে চান বলে মেহমুদকে আস্বস্ত করেন।
এরআগে ঢাবির সাবেক উপাচার্য বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফের মধ্যে ফোনালাপ ফাঁস হয়। ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে আসন বণ্টন নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা মাহামুদুর রহমান মান্না ও আ স ম রবকে ফালতু বলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও নোয়াখালী-১ আসনে দলটির প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের ফোনালাপ। ওই ফোনালাপে শোনা যায়, নুরনবী চৌধুরী নামে দলীয় এক কর্মীকে লাঠি-বাঁশ নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দিচ্ছেন খোকন। তিনি নজরুল, সাহেদ, মঠখোলার রিয়াজ, জাহাঙ্গীর, ডা. শিপনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবরকম প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন। গত ১৫ ডিসেম্ব^র নোয়াখালীতে নির্বাচনী প্রচারণার সময় দুপক্ষের সংঘর্ষে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশের ভাষ্য, দুপক্ষের সংঘর্ষে বাধ্য হয়ে পুলিশ গুলি ছুড়েছে। একই সঙ্গে ফাঁস হয়েছে বরিশাল-২ আসনের বিএনপির প্রার্থী সরদার সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টুর ফোনালাপ। কর্মীদের নাশকতার প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দিতে শোনা যায় ওই ফোনালাপে। ২৪ ডিসেম্ব^র সোমবার বরিশালের বানারীপাড়ায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় কয়েকটি যানবাহনে ভাঙচুর করা হয়। সংঘর্ষে দুপক্ষের বেশ কিছু নেতাকর্মী আহত হন। ফোনালাপে শোনা যায়, সান্টু বিরোধীপক্ষকে গুলি করার হুমকি দিয়ে নিজ নেতাকর্মীদের প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ফোনালাপে সান্টু বলেন, এখন আর্মি আসছে, এখন আমি বের হবো। মুখোমুখি হলেই মারব। আমি ওসিকে বলছি, বানারীপাড়ায় আসব। রাস্তা ক্লিয়ার করেন নইলে কিন্তু প্রতিহত করব, আমি কিন্তু গুলি করে দেব। আমার সামনে যেটা পড়বে আমি গুলি করে দেব।
গত আগস্ট মাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ফোনালাপ ফাঁস হলে আইসিটি আইনে মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। খসরু কুমিল্লার এক ছাত্রকে ঢাকায় আন্দোলনে সক্রিয় হতে আহবান জানান। পুলিশ ওই ছাত্রকেও গ্রেপ্তার করে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাজ পড়ে নাশকতা চালানোর একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) মিজানুর রহমানের ওই ফোনালাপের সূত্র ধরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। আশুলিয়ার শিমুলিয়া ইউনিয়ন যুবদল নেতা সাইফুলকে তিনি এমন নির্দেশনা দেন বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়।