ঘূর্ণিঝড় ইয়াস : পানিতে ডুবে ৫ শিশুর মৃত্যু, প্লাবিত বহু এলাকা

প্রকাশিত: ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ, মে ২৭, ২০২১

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদীর পানি বেড়ে গেছে। আর এর প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে বেশ কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পৃথক স্থানে পানিতে ডুবে প্রাণ গেছে পাঁচ শিশুর। এছাড়া পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ো হাওয়ায় বিধ্বস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। ডুবে গেছে ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ি, ভেসে গেছে কয়েকশ পুকুরের মাছ।

বুধবার (২৬ মে) ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির খবর পাঠিয়েছেন টাইমস বিডির প্রতিবেদকরা। এ নিয়ে তাদের পাঠানো তথ্য তুলে ধরা হলো-

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের খাউলিয়া এলাকায় পানিতে ডুবে জিনিয়া আক্তার (৪) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার দুপুরের দিকে উপজেলার খাউলিয় ইউনিয়নের চালিতাবুনিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। চালিতাবুনিয়ার নির্মাণ শ্রমিক কালাম গাজীর মেয়ে জিনিয়া।

স্থানীয়রা জানায়, বুধবার দুপুরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে খাউলিয়ার চালিতাবুনিয়া গ্রামে পানি ঢোকে। অস্বভাবিক পানি বেড়ে যাওয়া ওই গ্রামের কালাম গাজীর স্ত্রী লিজা বেগম তার শিশুকন্যা জিনিয়াকে ঘরে রেখে গরু আনতে আনতে যান। কিছুক্ষণ পরে ঘরে এসে মেয়েকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে তাকে ঘরের পাশে পানিতে পান তিনি। পরে মোড়েলগঞ্জ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বরিশালের বাকেরগঞ্জে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার উপজেলার পৃথক স্থানে এ ঘটনা ঘটে।মৃত শিশুরা হলো- উপজেলার নিয়ামতি ইউনিয়নের ঢালমারা গ্রামের হাফিজুর রহমানের মেয়ে সুমাইয়া আক্তার (৩) এবং গারুরিয়া ইউনিয়নের রুনসী পশুরি গ্রামের আজগর আলীর মেয়ে আজওয়া আক্তার (৩)।

সুমাইয়ার স্বজনরা জানান, জোয়ারের পানিতে বসতবাড়ির আশপাশ পানিতে প্লাবিত হয়। পরিবারের সদস্যদের অগোচরে সুমাইয়া ঘর থেকে বের হয়। তাকে না পেয়ে স্বজনরা খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। একপর্যায়ে পুকুর পাড়ে পানিতে ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

আজওয়ার স্বজনরা জানান, দুপুরে বাড়ির সামনে জোয়ারের পানিতে খেলছিল আজওয়া। ঘণ্টাখানেক পর পরিবারের সদস্যরা বাড়ির পাশে ডোবায় ভাসতে দেখে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

এদিকে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে বিষখালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ডুবে প্রাণ গেছে মো. সিয়াম হোসেন (৮) ও সামিয়া আক্তার (৪) নামে দুই শিশুর।

বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে উপজেলার মেডিকেল মোড় সংলগ্ন ও বড়ইয়া এলাকায় পৃথক এই ঘটনা ঘটে। সিয়াম উপজেলার পিংড়ি গ্রামের মো. ফারুক হাওলাদারের ছেলে। সে আজিজিয়া নূরানী কিন্ডারগার্টেন মারদাসার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো। আর সামিয়া আক্তার বড়ইয়া এলাকার সাইলু আকনের মেয়ে।

রাজাপুরে ব্যাপক হারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বিষখালী নদীতে বেড়িবাঁধ না থাকায় পানি ঢুকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই সঙ্গে ভেসে গেছে কয়েকশ পুকুরের মাছ।

ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বুধবার বেলা ১১টা থেকে জোয়ারের পানিতে চরইশ্বর, সুখচর, সোনাদিয়া, তমরদ্দি, হরনী, চানন্দী ও নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের পানি বন্দি মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করছে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মোংলা ও আশপাশের উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে পশুর নদীর বাঁধ সংলগ্ন কানাইনগর, চিলা ও জয়মনি এলাকার চারশতাধিক বসতঘর তলিয়ে গেছে। চিংড়িসহ অসংখ্য মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে কেউ আসেননি।

বুধবার (২৬ মে) দুপুর ২টার দিকে প্লাবিত এলাকা পরিদর্শনে যান মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার। তিনি বলেন, মোংলার উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীতে দুপুর ১২টা থেকে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এর ফলে পশুর নদী সংলগ্ন অনেক বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে।

মোংলা চাদপাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোল্লা তারিকুল ইসলাম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের খামখেয়ালীর কারণে জোয়ারের পানিতে বন্ধী হয়ে পড়েছে চিলা ও চাদপাই ইউনিয়নের তিন গ্রামের কয়েকশ বাসিন্দা, ভেসে গেছে কয়েক হাজার বিঘা মৎস্য ঘেরের মাছ।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাঠকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ছিলাম। চিলার কেয়াবুনিয়া ও জয়মনি এলাকায় ৫০০-৬০০ বিঘা মৎস্য ঘের তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আমরা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করছি।

এদিকে ইয়াসের প্রভাবে অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় দেশের ৯ জেলার ২৭ উপজেলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে সার্বিক ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এ কথা জানান। ভোলার লালমোহন উপজেলায় গাছ চাপা পড়ে একজন মারা গেছেন বলেও জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।

তিনি জানান, অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ২৭টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, শরণখোলা, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, মঠবাড়িয়া, বরগুনা সদর, পাথরঘাটা, আমতলী, পটুয়াখালী সদর, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, মির্জাগঞ্জ, কলাপাড়া, চরফ্যাশন, মনপুরা, তজুমদ্দিন, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, ভোলা সদর, হাতিয়া, রামগতি ও কমলনগর।

jagonews24

প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকদের অনকূলে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী ও অর্থ বরাদ্দ দেয়া আছে। এছাড়াও আজ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় ৯টি জেলার ২৭টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা দিতে ১৬ হজার ৫০০ শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এদিকে ভারতে ওড়িশা রাজ্যের উত্তর উপকূলে আছড়ে পড়ার পরপরই শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। মঙ্গলবার রাতে শক্তিশালী থেকে অতি-শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত গিয়েছিল সেটি। কিন্তু বুধবার দুপুরে স্থলভাগে পৌঁছেই শক্তি হারাতে শুরু করে ঝড়টি।

ভারতের আবহাওয়া অফিস বলছে, স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওড়িশার উত্তর উপকূলে আছড়ে পড়ে ইয়াস। সেই সময় এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার। দমকা হাওয়ার বেগ কখনো কখনো ঘণ্টায় ১৫৫ কিলোমিটারেও পৌঁছায়। তবে এরপর ক্রমেই শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে ঝড়টি।